বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপ: খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ

দেশের প্রতি চারজনের একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। আর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৬ শতাংশ আছেন এ অবস্থায়। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি মাসে প্রকাশ করা এক জরিপ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
‘বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট : মে-আগস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত ৩ অক্টোবর।
খাবার কিনতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে বাকিতে খাবার কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা চলতি বছরের মে মাসে ছিল ৩২ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ৪৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাকিতে খাবার কিনতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা সিলেটে ৫৩ ও চট্টগ্রামে ৫৮ শতাংশ। এসব মানুষ সরকারি ও বেসরকারিভাবে খুব বেশি সহায়তাও পাননি। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ আগস্ট মাসে সহায়তা পেয়েছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি ১০ পরিবারের ৩টি পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না। আর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় এ হার জনসংখ্যার অর্ধেক। দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ কম পরিমাণে ও সস্তা খাবার কিনছেন। সামগ্রিকভাবে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমেছে।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ‘বাংলাদেশ মার্কেট মনিটর : মে-জুলাই’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ডব্লিউএফপি। সেখানে সংস্থাটি প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং রিজার্ভ-সংকটের (বৈদেশিক মুদ্রা) কারণে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে উল্লেখ করে। একইসঙ্গে সার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় চাল ও সবজির মতো খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে বলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। গত আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ শতাংশ কমেছে এবং টাকার মান এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এছাড়া ২০২২ সালের এপ্রিলে প্রকাশ করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা ও ব্যয় জরিপে দেশে দারিদ্র্য ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ বলা হয়েছিল। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও দারিদ্র্যের হার কমেছে বলে এ জরিপে উঠে আসে।
দেশের নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর অবস্থা বুঝতে মিরপুরের পূর্ব কাজীপাড়ার বাসিন্দা মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন তিনি। পরিবারের অন্য তিনজনের দুজন দিনমজুরির কাজ করেন। সব মিলিয়ে পরিবারের আয় মাসে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। পরিবারে তিন বেলার খাবার জোগাতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, চালের দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু সবজি-ডিমের খরচ তো বেড়েছে।
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশের ২৪ শতাংশ মানুষ এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোয় ৪৬ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছেন। তবে মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর ৯ শতাংশ এবং উচ্চ আয়ের পরিবারের ৩ শতাংশ এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছে।
এদিকে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিসংক্রান্ত ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সোয়া পাঁচ কোটির বেশি মানুষ খাদ্যে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন ১ কোটি ৮৭ লাখ মানুষ।
ডব্লিউএফপির জরিপে ৭১ শতাংশ পরিবার খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে সর্বোচ্চ উদ্বেগের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি ১০ জনের ৭ জন জীবনযাত্রার মান কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। যাদের বড় অংশ আগের চেয়ে খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন, ঋণ করছেন এবং উৎপাদনশীল সম্পদ বিক্রি করছেন ও বাকিতে খাবার কিনছেন।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির বলেন, দেশে যে অভাবী মানুষ বেড়েছে, তা রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যায়। তাই একটি অংশের মানুষ যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন, তা সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে। ‘দেশে বিপুল পরিমাণে খাদ্য মজুদ আছে, উৎপাদন ভালো হয়েছে’, এসব কথা বললেই দরিদ্র মানুষের পেটে খাবার যাওয়া নিশ্চিত হয় না। এজন্য বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে।
ডব্লিউএফপি ২০২২ সালের জুলাই থেকে খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ করছে। সারা দেশ থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নেওয়া ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপরে এ জরিপ করা হচ্ছে। শুরুতে অতিমারি করোনার প্রভাব ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং ব্যয় বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে আসে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।