ক্রাইমবাতা রিপোট , সাতক্ষীরা: ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্ণিতির মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় কৃষি ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। ফলে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদে সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করেছে শত শত কৃষক। স্বল্প সুধে ঋণ দেওয়ার কথা বলে লাখে ১০/১২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার দলীয় বিভিন্ন বক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগ ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। পাশা পাশি প্রকৃত ও প্রান্তিক চাষিরা কৃষি কাজে পর্যাপ্ত কৃষি ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঋণের টাকায় কাঙ্খিত সূফল না পাওয়ায় অনেকে ঋণ খেলাপি হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, ১২ অক্টবর পর্যন্ত ৮৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণ বিরতণ করা হয়েছে, যা বরাদ্দের ২২ শতাংশ। এছাড়া ঋণ আদায় হয়েছে ৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকা অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ। কৃষকদের অভিযোগ, দালাল চক্রের সদস্যরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক গ্রাহক সৃষ্টি করেন। পরে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রতি লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে ১০/১২ হাজার আর ৫০হাজারে ৫/৬ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করে থাকেন। ঘুষের টাকা আবার দালাল ও ব্যাংক কর্মকর্তারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে থাকে বলে অভিযোগ অনেক ভুক্তভুগীর। কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরার ১৭টি শাখায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪০৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করেছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। খাদ্যশস্য, মৎস্য, পশু পালন, কৃষি যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য খাতে এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেলায় কৃষি উদ্যোক্তা বেড়েছে। ফলে তাদের চাহিদানুযায়ী ঋণ বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ, মুজিববর্ষ ও করোনাকালীন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে সরকার। তবে মাঠ পর্যায়ে সরকারি সুভিধা পেয়ে ভোগান্তির শেষ নেই কৃষকের। ঋণপ্রস্তাব থেকে শুরু করে টাকা পাওয়া পর্যন্ত পদে পদে দালাল ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন দরিদ্র কৃষক। এদিকে একটি প্রতারক চক্র ও ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে কৃষকদের নামে ঋণ তুলে নিজের পরিজনদের মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অথচ যাদের ঋণ পাওয়ার কথা তারা পাননি। আবার জায়গা-জমি নেই এমন অনেকে ঋণ পেয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছে,কৃষিতে ভর্তুকি থেকে শুরু করে আর্থিক ও কারিগরি সুবিধা দেয়ার জন্য কৃষকের সঠিক ডাটাবেজ থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই কৃষকের পরিপূর্ণ তথ্য নেই। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কাছে কৃষকের তথ্য থাকলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ নয়। সঠিক ডাটাবেজ না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রান্তিক কৃষকের কৃষিঋণের সুবিধা প্রদান কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরা মুখ্য আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলার ১৭ শাখার অধীনে চলতি অর্থবছরের জন্য কৃষি ঋণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৪০৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে খাদ্যশস্যে ঋণ বরাদ্দ দেয়া হয় ১১৩ কোটি, মৎস্য খাতে ২৪৩ কোটি, প্রাণিসম্পদ ও পশু পালনে ২৫ কোটি, সেচ ও কৃষি যন্ত্রাংশে ৩২০ কোটি, বীজ উৎপাদন ও খাদ্যশস্য বাজারজাতে ১ কোটি ২০ লাখ এবং দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য খাতে ১৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরা আঞ্চলিক অফিসের অধীনে ঋণ বরাদ্দ ছিল ৩০৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী চলতি অর্থবছর কৃষিঋণ বরাদ্দ বেড়েছে ১০৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে ৩৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ।২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্যে ঋণ বরাদ্দ দেয়া হয় ৮১ কোটি ৫০ লাখ, মৎস্য খাতে ১৭০ কোটি, প্রাণিসম্পদ পশু পালনে ২৩ কোটি, সেচ ও কৃষি যন্ত্রাংশে ৩ কোটি ৫০ লাখ, দারিদ্র্য বিমোচনে ৪ কোটি, শস্য গুদামজাত ও বীজ উৎপাদনে ১ কোটি ৫২ লাখ এবং অন্যান্য খাতে ২০ কোটি টাকা।
কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরা মুখ্য আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো রকম হয়রানি ছাড়াই প্রকৃত কৃষি উদ্যোক্তার মাঝে এসব ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন কৃষি ব্যাংকের গ্রাহক সেবার মান খুবই ভালো। একজন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক বা উদ্যোক্তা দালাল কিংবা হয়রানি ছাড়াই সরাসরি ব্যাংকে এসে ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন। শুধু তাই নয়, গ্রাহক যে খাতে ঋণ গ্রহণ করছেন প্রকৃতপক্ষে সেই খাতে বিনিয়োগ করছেন কিনা সেটিও মনিটর করা হচ্ছে ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তাছাড়া ঋণসংক্রান্ত ব্যাপারে কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরার ১৭টি শাখায় কোনো রকম আর্থিক লেনদেন বা অনিয়মের অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
কৃষি উদ্যোক্তা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাটিয়া এলাকার মো. আরিফুজ্জামান জানান, দেবহাটা উপজেলার শসাডাঙ্গা গ্রামে সাড়ে ছয় বিঘা জমির ওপর স্টার ফিশ প্রকল্প নামে একটি মৎস্য খামার রয়েছে তার। খামারে উৎপাদন বাড়াতে কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন স্টার ফিস প্রকল্পে। ২০২১ সাল থেকে ঋণ চলমান রয়েছে তার। কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণের টাকা পেয়ে অনেক উপকৃত হয়েছেন তিনি। তবে ঋণ নিতে তাকে তাকে অর্ধলক্ষাধীক টাকা খরচ হয়ে ছিল বলে জানা যায়। সাতক্ষীরার দহকুলা গ্রামের মৎস্য চাষী আজমল হোসেন জানান, মাছ চাষের ওপর ৩৫ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন কৃষি ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে পুরো অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি। ব্যাংকের বার্ষিক সুদ পরিশোধ ও মৎস্য ঘেরের উৎপাদন খরচ তুলেও প্রতি মৌসুমে ৮-১০ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে তার। তবে ঋণ নিতে তাকে ও গুণতে হয়েছে বাড়তি টাকা। আরিফুজ্জামান ও আজমলের মতো ৩৫-৩৬ হাজার কৃষি উদ্যোক্তা রয়েছেন সাতক্ষীরায়। এসব উদ্যোক্তা কৃষি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অংকে কৃষিঋণ নিয়ে গড়ে তুলেছেন কৃষি খামার। তাদেরর একই অভিযোগ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী,কৃষি স¤ম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রকৃত প্রান্তিক কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করবে। ওই ডাটাবেজ অনুযায়ী বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত কৃষক চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ দেবে। ব্যাংকিং সেবাকে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করাসহ হাটবাজারে প্রকাশ্যে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি প্রাস্তিক কৃষকের তালিকা প্রণয়নের সময় কোনো সম্ভ্রান্ত কৃষক অন্তর্ভুক্ত না হন এবং কেউ বাদ না পড়েন, সে দিকে দৃষ্টি রাখছে কৃষি মন্ত্রালয়।