বনে বাঘ, পানিতে কুমির, ডাঙ্গায় লোনা-এই নিয়ে বসবাস সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার মানুষের।
এছাড়া নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন, জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড় তাদের জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে। প্রতিবছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসংখ্য পরিবার তাদের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে হয় সর্বশান্ত।
তবে উপকূলীয় এলাকায় ছাগল-ভেড়া পালন ও বসতবাড়ির আঙিনায় শাক-সবজি চাষে স্বামীর পাশাপাশি পরিবারে ভূমিকা রাখছেন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা। এতে পুরুষ নির্ভর হতদরিদ্র পরিবারের নারীরা স্বামীর সাথে সাথে পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও জীবনমান উন্নয়নেও হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আর স্বচ্ছলতা ফিরেছে এসব হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে।
উপকূল জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার পানি ও মাটি লবণাক্ত হওয়ায় হতদরিদ্র পরিবারে পুরুষরা মূলত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ইটভাটায় শ্রমিক, সুন্দরবন নির্ভর, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা এবং রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে রিকশা চালকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে এসব পরিবারের নারীদের প্রয়োজনীয় কিছু পেতে দিনের পর দিন পুরুষদের উপর নির্ভর করে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো। এই অপেক্ষার পালাকে আরও ভারী করে তোলে প্রতি বছরের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
বর্তমানে দিন বদলের অগ্রযাত্রায় এসব অঞ্চলের নারীরা পরিবারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। জাতীয় পর্যায়ের একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতা নিয়ে দুই উপজেলার নারীরা এখন স্বাবলম্বী এবং অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ।
ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রজেক্ট (এএসডি) এর মাধ্যমে আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়ার বিছট, কাকবাশিয়া, দক্ষিণ একসরা প্রতাপনগরের চাকলা, কুড়িকাহনিয়া এবং শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পশ্চিম পাতাখালী, দক্ষিণ ঝাপা, সোনাখালী, চন্ডিপুর ও বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের কলবাড়ি দাতিনাখালী চুনার গ্রামের মোট ১২টি গ্রামের ৩৬১টি পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে সক্রিয় গৃহিণীদের ছাগল, ভেড়া ও মৌসুম ভিত্তিতে গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন ২৪ প্রকারের শাক-সবজি বীজ প্রদান এবং লবণাক্ত জমিতে সবজি চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
এছাড়া সবজি চাষে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ও ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার সহযোগিতা করে সংস্থাটি। তাছাড়া দুর্যোগাকালীন সময়েও যাতে সবজি উৎপাদন অব্যাহত থাকে সেজন্য মাচা ও বেড পদ্ধতিতে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্প। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বস্তায় আদা চাষে উৎসাহিত করায় গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বস্তায় আদা চাষ হচ্ছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চুনার আশ্রয় প্রকল্পের লুৎফা বেগম জানান, স্বামীর উপার্জনের উপরই নির্ভর করে সংসার চলতো। ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতা নিয়ে প্রথমে বাড়ির অঙিনায় সবজি চাষ করেছিলাম। সবজির ফলন ভালো হওয়ায় নিজেরা খাওয়ার পর বাজারে বিক্রয় করে গত বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা হাতে এসেছে। চলতি শীত মৌসুমে বড় পরিসরে বাড়ির আঙিনাসহ পাশের জমিতে সবজি চাষ শুরু করেছি। এখন সংসারে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে পারি। সন্তানের লেখাপড়ার কিছু খরচও দিতে পারি।
পদ্মপুকুর ইউনিয়ানের দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের তপন কুমার মন্ডলের স্ত্রী সবিতা রানী বলেন, অভাবের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির স্বামীর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ি পোনা ধরতাম। বর্তমানে ভেড়া পালন ও সবজি চাষে আমি স্বাবলম্বী। আর স্বামীর কাছে কিছু চাইতে হয় না। নিজের টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারি।
একই ইউনিয়ানের পাতাখালী গ্রামের বাঘ বিধবা সুফিয়া খাতুন বলেন, অভাবের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী মারা যাওয়ার পর খুব অসহায় ছিলাম। বর্তমানে ফ্রেন্ডশিপের দেওয়া ছাগল ও ভেড়া পালন শুরু করে অনেক লাভবান হয়েছি। একটি ছাগল থেকে ১৩টি ছাগলের ও ভেড়ার মালিক হয়েছি। তা থেকে ৬টি ছাগল একসঙ্গে বিক্রি করে বাড়ির পাশের একটি পুকুরে নরম কাঁকড়া উৎপাদনের পয়েন্ট করেছি। একমাত্র ছেলেকে এখন আর সুন্দরবন যেতে দেই না।
শ্যামনগরের উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আতাউল হক দোলন বলেন, আমার এলাকার বেশির ভাগ মানুষ দরিদ্র। তারা মূলত সুন্দরবন বা ইটভাটার উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে নারীরা তাদের সংসারের আয়ে ভূমিকা রাখছে।
বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন নারীরা এতদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনের নদীতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতো। এতে জরায়ুমুখের ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতেন তারা। এখন তারা বাড়ির পতিত জায়গায় সবজির চাষ করে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা বলেন, লবণাক্ত এলাকায় উন্নত জাতের বিভিন্ন প্রকারের শাক-সবজি বীজ বিতরণ করছে ফ্রেন্ডশিপ সংস্থাটি। আমরাও ইতোমধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষাবাদের জন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
শ্যামনগর উপজেলা প্রাণি সম্পদ সার্জন ডা. সুব্রত কুমার বিশ্বাস বলেন, ফ্রেন্ডশিপ বিনামূল্যে ছাগল-ভেড়া ও হাসঁ বিতরণ করছেন। এসব এলাকায় আধুনিক পদ্ধতিতে প্রাণীসম্পদ পালনের প্রশিক্ষণ ও টিকা সরকারি ভাবে দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।
ফ্রেন্ডশিপ ট্রানজিশনাল ফান্ড (এএসডি) প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার জুয়েল হাসান জানান, ফ্রেন্ডশিপ লুক্সেমবার্গ-এর সহায়তায় সদস্যদের আয় রোজগার নিয়মিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো হতদরিদ্র পরিবারের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও দুর্যোগ সহনশীল সক্রিয় সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্রতা দূরীকরণ ও জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন করা।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …