আলোচনায় অনির্বাচিত সরকার

দলগুলোর ব্যর্থতার সুযোগ নেয় তৃতীয় পক্ষ

রাজনীতিবিদদের সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে -ড. কামাল হোসেন * নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায় -মো. হারুনুর রশীদ * আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা যেতে পারে -ড. বদিউল আলম মজুমদার

ফের আলোচনায় অনির্বাচিত সরকার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, ঠিক তখন নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে অনির্বাচিত সরকার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই রোববার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় এ নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একটি মহল বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকার দেখতে চায়।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার এই আশঙ্কার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাসহ দেশের বিশিষ্টজনরাও। তাদের মতে, নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান এবং সংকট উত্তরণে তাদের আলোচনার টেবিলে বসতে না পারার সুযোগ নিতে চায় তৃতীয় পক্ষ। এদের মূল চাওয়া সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করা। এর আগেও তারা দুই বড় দলের রাজনৈতিক মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যে কারণে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি অনির্বাচিত সরকারকে প্রায় দুই বছর দেশ পরিচালনা করতে দেখা গিয়েছিল।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। আমরা পাকিস্তান আমলে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এই গণতন্ত্রের জন্যই। স্বাধীনতার পরেও আমরা সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, যার মূলে ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

রাজনীতিতে নানা মত ও পথ থাকবে, দিনশেষে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সংকটের সুযোগ সবসময় তৃতীয় একটি পক্ষ নিতে চাইবে। এজন্য রাজনীতিবিদদের সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে তখন দেশে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। সেই থেকে ঘুরেফিরে কখনো বিএনপি আবার কখনো আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়।

একই সঙ্গে দেশের মানুষ বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নানা ইস্যুতে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থান দেশে বিদেশে কারো কাছেই আর অজানা নেই। কখনো কখনো তাদের এই বিরোধের সুযোগ নেয় তৃতীয় পক্ষ। যার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ২০০৭ সালের এক এগারোর সেনা সমর্থিত সরকার। দুই বছরের ওই সরকারের হাতে দিন শেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের রাজনীতিবিদরাই। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীরাও।

রাজনৈতিক বিশ্লেকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা বিরোধ সত্ত্বেও অনির্বাচিত সরকারের চাইতে নির্বাচিত সরকার যে অনেক ভালো, তা এক এগারোর সরকারের কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে দিয়েছিল। যদিও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির অন্দরমহলে জাতীয় সরকারের নামে একটি অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অনেক দিন থেকেই আলোচনা হচ্ছে।

মাঠের বিরোধী দল বিএনপির বলয়ে থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোট, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি জোট এবং রাজনৈতিক দল জাতীয় সরকারের নামে অনির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে ন্যূনতম দুই থেকে তিন বছরের জন্য দেশ পরিচালনার কথা প্রকাশ্যেই বলছে। আওয়ামী লীগসহ তাদের বলয়ে থাকা দলগুলো আবার এর বিপক্ষে। তারা মনে করছেন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করতেই বিরোধী দল জাতীয় সরকার কিংবা অনির্বাচিত সরকারের কথা বলছেন।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায়। দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা (পশ্চিমারা) জানে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। এ জন্য তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। নির্বাচন বানচাল করে একটি অনির্বাচিত সরকার বসাতে চায়। এটা করতে পারলে তাদের তারা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। আমরাও যাতে নির্বাচনে অংশ না নেই, সেই ষড়যন্ত্র চলছে। এটা হলে তারা তাদের (পশ্চিমারা) ইচ্ছেমতো ব্যক্তিদের ক্ষমতায় বসাতে পারে। তবে এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমন কথা বলেছেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা ঠিক এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তিনি নিজেই দায়ী। যদিও অনির্বাচিত সরকার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

দেশবাসী এ ধরনের সরকার অতীতে মেনে নেয়নি, আগামীতেও মেনে নেবে না। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে পদত্যাগ করে একটি তদারকি সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যদিও আওয়ামী লীগ দাবি করছে, এ ধরনের ব্যবস্থা সংবিধানে নেই।

কিন্তু সংবিধান সংশোধন করার তো সুযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আমি আগেও বলেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। তারা একটি হামিদ কারজাই মার্কা অনির্বাচিত সরকার এদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই কথাই বলেছেন। তার এই কথার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের শরিকরা বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে আগামী নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তারা দেশে সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা নস্যাৎ করে অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

যদিও এ অভিযোগ আমলে নিতে নারাজ মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মো. হারুনুর রশীদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। আমাদের দাবি মেনে নিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সরকারি দল তা করতে চায় না। তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের অধীনে আবারও একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে চায়। এজন্য তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমরা রাজপথে আন্দোলন করছি। তৃতীয় কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য না। আমরা চাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আর এটা শেখ হাসিনার অধীনে কোনোভাবেই সম্ভব না, অতীত অভিজ্ঞতাও তাই বলে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, একদল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আরেক দল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না।

বিপত্তি এখানে। যা আলোচনার টেবিলে বসে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো পক্ষই আলোচনায় বসতে চায় না। বা আলোচনার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। দুপক্ষ অনড় থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যার খেসারত সবাইকেই দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুই বড় দলের বিরোধের সুযোগ নিয়ে এক এগারোর সরকার এসেছিল। সেই অভিজ্ঞতা রাজনীতিবিদদের জন্য সুখকর ছিল না। আগামীতেও এরকম সরকার এলে তা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। jugantor.com

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।