সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়রের পদ হারাচ্ছেন বিএনপির জনপ্রিয় নেতা তাজকিন

সাতক্ষীরা সংবাদদাতা: সাতক্ষীরা পৌর বিএনপির সদস্যসচিব ও সাতক্ষীরা পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র তাজকিন আহমেদ চিসতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নাশকতা ও সরকারবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলে ১২ জন নির্বাচিত কাউন্সিলরের করা অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর মেয়র পদ হারাতে চলেছেন। তাজকিন আহমেদ সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পৌর বিএনপির সদস্যসচিব। এর আগেও স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তাঁকে তিনবার বরখাস্ত করা হয়।

জেলা প্রশাসক বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত ৩ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষ্ণুপদ পালকে নির্দেশ দেন। নির্দেশমতো তিনি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদকে ‘অনাস্থা প্রস্তাব’এর পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যধারা কেন গ্রহণ করা হবে না, এ মর্মে এই চিঠি পাওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তাজকিন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠির জবাব নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না দেওয়ায় কাউন্সিলর ফিরোজ হাসানকে (ভারপ্রাপ্ত মেয়র) অনাস্থা প্রস্তাবসম্পর্কিত সভা ডাকার আহ্বান জানান। ১৮ অক্টোবর বেলা তিনটার দিকে সাতক্ষীরা পৌরসভা পরিষদকক্ষে ভারপ্রাপ্ত মেয়র কাজী ফিরোজ হাসানের সভাপতিত্বে সভায় ১২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১১ জন উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত ১১ জনই অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। তবে ওই সভায় পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন না।

পৌরসভা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া এবং বিধিবহির্ভূতভাবে পৌরসভার ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডার-সংলগ্ন জমিতে মার্কেট নির্মাণের দরপত্র আহ্বানসহ ১০ দফা অভিযোগ উল্লেখ করে পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদের বিরুদ্ধে ১২ কাউন্সিলর গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অনাস্থা প্রস্তাব দাখিল করেন।

সাতক্ষীরা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ শফিক উদ দৌলা; ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নূরজাহান এবং ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর রাবেয়া পারভীন অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ও বিপক্ষে কোনো ধরনের প্রশাসনিক কিংবা রাজনৈতিক চাপ ছিল না উল্লেখ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, মেয়র তাজকিন আহমেদ তাঁদের কোনো কথা শুনতেন না। তাঁদের মূল্যায়ন করতেন না। তিনি কাউন্সিলরদের কোনো মতামত না নিয়ে একক সিদ্ধান্তে পরিষদ চালাতেন।

সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী নাজিম উদ্দীন বলেন, তাজকিন আহমেদ পৌর মেয়ের পদের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। অথচ তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হানিকর ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত। রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। সাতক্ষীরা পৌরসভার বাস্তবায়িত ‘জলবায়ু–সহিষ্ণু অবকাঠামো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রকল্প’ প্রক্রিয়ার দরপত্রে তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, বিধিবিধান অনুসরণ না করে পৌরসভার সদস্যদের অবমূল্যায়ন, পরিষদ সভার আলোচনার মাধ্যমে পাস করা শহীদ আবদুর রাজ্জাক পার্কের ফটক নির্মাণ, সাতক্ষীরা নিউমার্কেটের নির্মাণসংক্রান্ত কাজ শেষ না করে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পৌর পরিষদ অকার্যকর করে নিজের খেয়ালখুশিমতো পৌরসভা পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিষ্ণুপদ পাল মুঠোফোনে বলেন, তাজকিন আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। অনাস্থা প্রস্তাবকারী ১২ জনের মধ্যে ১১ জন কাউন্সিলরই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। সভার কার্যবিবরণীসহ তিনি একটি প্রতিবেদন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কাছে দ্রæত জমা দেবেন তিনি। তারপর জেলা প্রশাসক নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ মুঠোফোনে বলেন, ‘অনাস্থার ব্যাপারে আমি কিছু জানিনে। আমাকে জানানো হয়নি। আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ কারণে অন্যায় করে, জুলুম করে এবং আইন অমান্য করে মেয়র পদটি দখল করার জন্য এসব করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফারহানা মান্নানকে গত ৩ আগস্ট চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু উপসচিবের পক্ষ থেকে ওই চিঠি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। তিনি জানান, বিদেশে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে একাধিক নাশকতার মামলা দিয়েছে পুলিশ।

পৌরসভা, বিভিন্ন অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তাজকিন আহমেদ পরপর দুবার মেয়র নির্বাচিত হন। প্রথম মেয়াদে দুটি নাশকতা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করার পর ২০১৬ সালের ৪ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক চিঠিতে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে অবশ্য তা প্রত্যাহার হয়। দ্বিতীয় মেয়াদে ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৭০১ টাকা পানির বিল মওকুফ, হাটবাজার ইজারা বাবদ ৬৬ লাখ ৭০ হাজার ৯৭০ টাকা বকেয়া, পৌর কর ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার ৯৪৩ টাকা এবং ট্রেড লাইন্সেস ফি ১৪ লাখ ১৩ হাজার ৭২৬ টাকা মওকুফ করাসহ বিভিন্ন অনিময় ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০২২ সালের ১৫ জুন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া নাশকতার মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হওয়ায় চলতি বছরের ৬ ফেব্রæয়ারি তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের এই আদেশ হাইকোর্টের নির্দেশে পরবর্তী সময়ে প্রত্যাহার হয়।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।