॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে আওয়ামী লীগের। শীর্ষনেতাদের এ উপলব্ধি এলেও তৃণমূল পর্যায়ে যাতে নেতিবাচক কোনো ধারণা তৈরি না হয়, নেতাকর্মীদের মনোবল নষ্ট না হয়, সে কারণে পরিস্থিতি উত্তরণে মরিয়া আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির সামনে এখন বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেসব নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা খুবই চিন্তিত। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর নিয়ে সরকারের ঘুম হারাম। কারণ ১৭ বছর ধরে রাজপথে থাকা বিরোধীদল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাজধানীতে পৃথক পৃথক কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং জামায়াতে ইসলামী ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকেছে। এ দুই সমাবেশের উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। দুটি দলই ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শো-ডাউন দেখাবে। এ দুই দলের কর্মসূচির দিনে আওয়ামী লীগও ঢাকায় বড় ধরনের গণজমায়েত করতে চাইছে। দলটি জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করার জন্য ইতোমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে অনুমতিও নিয়ে নিয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত স্থানে সমাবেশ করতে অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে ডিএমপিকে।
এবার ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ থেকে বিএনপির মহাযাত্রা ঘোষণা দেওয়া এবং জামায়াতে ইসলামী একইদিন মতিঝিলে সমাবেশ ঘোষণা দেওয়ায় আওয়ামী লীগের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। কোনদিক সামলাবে দলটি? একদিকে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, এতে জনগণ অতিষ্ঠ, আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীরাও দলটিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনার জোর তাগিদ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ইচ্ছা ছিল ভোটের আগে দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, কিন্তু সরকার সে কাজে ব্যর্থ হয়েছে। দিন দিন দাম বাড়ছে, এতে সরকার চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড মানুষের সামনে তুলে ধরতে এবং কিছু মেগাপ্রকল্প নির্বাচনের আগে উদ্বোধন করতে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। এ ফর্মুলায়ও সরকার সফল হয়নি, উদ্বোধনের অপেক্ষমাণ প্রকল্পগুলো কাজ এখনো শেষ হয়নি। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হয়ে গেল, কিন্তু এ তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করতে মানুষকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে ফলে মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যবহারের উপযোগী হওয়ার আগে কেন উদ্বোধন করতে হবে। অর্থাৎ এতেও ইতিবাচক ফল আসেনি।
আর এরই মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছে গেছে। বিএনপি-জামায়াত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় যে পৃথক সমাবেশ ঘোষণা দিয়েছে, ওই সমাবেশে সরকার কোনো বাধা দেবে কিনা- এমন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ বিগত দিনের মতো সরকারের এমন চিন্তা থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নের কারণে সে চিন্তা শতভাগ বাস্তবায়ন করার সুযোগ কমে গেছে। আগামী ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে ঢাকায় প্রবেশের সড়ক বন্ধ করা হবে কিনা-ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে জানতে চেয়েছিলেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। যদিও তার বক্তব্যের পর দূতাবাসের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। গত ২২ অক্টোবর রোববার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের রাস্তা বন্ধ করার চিন্তা ও পরিকল্পনা নেই। তবে বিএনপি যেন সহিংসতা না করে বা চলাচলের পথ যেন বন্ধ না করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যদি ১০ লাখ লোক বা আরও বেশি ঢাকা শহরে ঢোকে, যেটা তারা (বিএনপি) বলছেন, তাহলে তো মিসম্যাচ হয়ে যাবে কমিউনিকেশন, এটা-ওটা। এগুলো যাতে তারা না করে, সেটার জন্য আমরা অনুরোধ করব। পিটার হাস বলেছেন, আপনারা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেবেন নাকি? আমরা বলেছি, আসা-যাওয়া বন্ধ কেন করব! ঢাকায় তো সবারই প্রয়োজন। রোগীর প্রয়োজন, বিদেশে যাওয়ার হলে সবকিছু তো ঢাকাকেন্দ্রিক। কাজেই আসা-যাওয়া বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না। তারা আসবে, তারা যাবে, সেখানে আমরা বাধা দেব না। আমরা শুধু এটুকু বলব, তারা যেন কোনো ভায়োলেন্সে লিপ্ত না হয়। রাস্তায় চলাচল তারা যেন সচল রাখে। এটুকুই আমাদের রিকোয়েস্ট।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সমাবেশ নিয়ে যখন পিটার হাস কথা বলেন, তখন আশঙ্কার বিষয়টি স্পষ্ট হয়, শঙ্কা যে দৃশ্যমান তা প্রমাণিত হয়। কারণ বিগত দিনেও বড় কর্মসূচি দিলে সরকার অঘোষিতভাবে পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। এদিকে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে রাজপথ। বিএনপিও কর্মসূচি দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো সহিংসতা হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। নেতাদের উজ্জীবিত রাখার জন্য আমাদের নেতারা বলবেনই এগুলো। কেউ বলবে আমরা দখলে রাখব, কেউ বলবে তারা দখলে রাখবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আমার কথা হলো, সাধারণ মানুষের যাতে কোনো ভোগান্তি না হয়, সেই অনুরোধ রাখব।
বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচির দিনে ঢাকা দখলে রাখতে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে একাধিক সভা করেছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা, ঢাকা জেলা শাখা, নির্বাচিত দলীয় জনপ্রতিনিধি এবং সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মতবিনিময় সভা গত ২৫ অক্টোবর বুধবার অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন বিকাল ৩টায় তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ নেতা, মহানগরের অন্তর্গত থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা, উপজেলা-থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচিত দলীয় সব জনপ্রতিনিধি এবং সব সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্ব অনুষ্ঠিত সভায় ২৮ অক্টোবর সতর্ক অবস্থান ও দলীয় সমাবেশ সফল করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
গত ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনের সরকারি দলের সভাকক্ষে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের এক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, এবার নির্বাচন কঠিন হবে। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাই জোর প্রস্তুতি নিতে হবে। নৌকা যাকে দেওয়া হবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে জয়ী করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ না থাকলে জয় সহজ হবে না। জিততে হলে জনসম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা বাড়ান। সভায় সংসদ-সদস্যদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, লালমনিরহাটের মোতাহার হোসেন, রাজবাড়ীর কাজী কেরামত আলী, লক্ষ্মীপুরের নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, চট্টগ্রামের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী, সংরক্ষিত আসনের এমপি অ্যারোমা দত্ত, রুবিনা আকতার মিরা প্রমুখ বক্তৃতা করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সামনেই রাজবাড়ীর দুই এমপি জিল্লুল হাকিম ও কাজী কেরামত আলী বাহাসে লিপ্ত হন। এমপিরা তাদের বক্তব্যে স্থানীয় গ্রুপিংয়ের তথ্য দলীয় সভাপতির দৃষ্টিতে আনেন বলে একটি সূত্রে প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘দেশের বিরুদ্ধে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে এমনটি নয়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় একটি মহল চায় বাংলাদেশে পাপেট (পুতুল) সরকার নির্বাচিত হোক। তারা আবারও একটি অনির্বাচিত সরকার আনার ষড়যন্ত্র করছে। এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।’ সভায় বিরোধীদলের আন্দোলন ও ২৮ অক্টোবরের বিষয়েও কথা ওঠে। তিনি বলেন, ওরা আন্দোলন করে করুক। আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। তবে আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাস বা নৈরাজ্য করতে চাইলে ছাড় দেওয়া হবে না। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও চ্যালেঞ্জিং হবে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য প্রফেসর আবদুল খালেক, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এডভোকেট কামরুল ইসলাম ও ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনসহ দলটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা বলছে, বিরোধীদল কর্মসূচি পালন করতে চাইলে কোনো অসুবিধা নেই, এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু অগণতান্ত্রিক কিছু করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, আওয়ামী লীগের উচিত বিরোধীদলগুলোর কর্মসূচিতে বাধা না দেওয়া। তারা তাদের মতো করে আন্দোলন করুক। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত হওয়া। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এখনো সময় আছে আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করা, সংঘাতের পথ বেছে নিলে পরিস্থিতি শুভ হবে না।
প্রসঙ্গত, গত ১০ ডিসেম্বরের মতো ২৮ অক্টোবরও প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডে সতর্কাবস্থায় থাকবেন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর বাইরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হবে সতর্ক পাহারা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মোড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে শামিয়ানা টাঙিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেবেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর সঙ্গে দলীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলররাও তাদের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে থাকবেন। রাজধানীজুড়ে এমন অবস্থানের পাশাপাশি এদিন মহাসমাবেশের মাধ্যমে বড় শোডাউন করবে দলটি। সব মিলিয়ে ২৮ অক্টোবর রাজনীতির মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারি দল। এদিকে কর্মসূচি ঘিরে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দিতে চান না ক্ষমতাসীনরা। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কঠোর মনোভাবের কথাও জানিয়েছেন তারা। পাশাপাশি বিরোধীদলগুলোর গতিবিধি কী হবে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, সেদিকেও লক্ষ রাখছে আওয়ামী লীগ।
Check Also
আশাশুনিতে টঙ্গী ইজতেমায় হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।ঢাকার টঙ্গীত ইজতেমা-মাঠে নিরীহ মুসল্লিদের উপর উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সাদ পন্থীদের বর্বরোচিত হামলা ও পরিকল্পিত …