জোয়ারাধার পদ্ধতি না রাখায় সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ৪৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পে সুফল না পাওয়ার শঙ্কা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অভিযোগ উঠেছে। এই প্রকল্পে জোয়ারাধার পদ্ধতি না রাখায় সুফল না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চার বছর আগে সাতক্ষীরার পাঁচ উপজেলায় জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খননের ওই প্রকল্পের জোয়ারাধার (টিআরএম) পদ্ধতি না রাখায় সুফল পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন নদী ও পানিবিশেষজ্ঞরা। বিশেজ্ঞরা বলছে, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ আমলে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দেশে দেখা যায় তার উল্টোটা, বরং ঠিকঠাক সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জনগণের টাকা অপচয় করাটাই নিয়ম হয়ে গেছে। ফলে বড় বড় অনেক প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। সাতক্ষীরার পাঁচ উপজেলায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য একটি প্রকল্পের এমন দশা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর না হলে জেলার লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তি পোহাবেন।

সড়ক যোগাযোগকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং দখল আর অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলো তাদের চরিত্র হারাচ্ছে। অনেক এলাকায় নদী নাব্যতা হারিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। এসব জলাবদ্ধতার তুলনায় নগরের জলাবদ্ধতাকে অনেকটা সাময়িক জলজট বলা যায়। কারণ, নানা অঞ্চলে নদীগুলোর কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিন থেকে যায়। এমন জলাবদ্ধতা নিরসনে চার বছর আগে সাতক্ষীরায় এক প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০২০ সালে শুরু হওয়ায় এ প্রকল্প শেষ হবে আগামী বছর।

তবে নদী ও পানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরিচ্চাপ ও বেতনা নদী খননের ওই প্রকল্পের জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) পদ্ধতি না রাখায় সুফল পাওয়া যাবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর দেখা যেতে পারে জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর না হয়ে মানুষের ভোগান্তিআরও বেড়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) পক্ষ থেকে জরিপ করে বেতনা ও মরিচ্চাপের অববাহিকার বিলে জোয়ারাধার পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু প্রকল্প থেকে জোয়ারাধার পদ্ধতি বাদ দিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

বেতনা ও মরিচ্চাপ—দুটিই জোয়ার-ভাটার নদী হওয়ায় নাব্যতা রক্ষার জন্য এখানে জোয়ারাধার গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সীমান্তনদী ইছামতীর সঙ্গে সাপমারা ও লাবণ্যবতী নদীর সংযোগ স্থাপন না করলে এ প্রকল্প সুফল বয়ে আনবে না। কিন্তু আইডব্লিউএমের সুপারিশ সত্ত্বেও কেন জোয়ারাধার পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রস্তাবটি বাতিল করা হলো? পাউবোর সাতক্ষীরা বিভাগের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাঁরা সাতক্ষীরায় মাত্র কয়েক মাস আগে এসেছেন, এমন চিরায়ত দায়সারা বক্তব্য দিয়েই দায় সারলেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পলি পড়ে বেতনা, মরিচ্চাপ, সাপমারা ও লাবণ্যবতী নদী ভরাট হয়ে গেছে। এতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ও পৌরসভা, আশাশুনি, দেবহাটা, তালা ও কলারোয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। একটু বৃষ্টিতে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ–ছয় মাস এসব উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও ফসলের জমি পানিতে তলিয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্প সাতক্ষীরার পাউবো বিভাগ-১ ও ২ বাস্তবায়ন করছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাতক্ষীরা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (বর্ধিতাংশ) নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নয়ন’ নামের চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বেতনা-মরিচ্চাপ নদী থেকে পলি অপসারণের মাধ্যমে এ অববাহিকায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও জনদুর্ভোগ প্রশমন হবে। এ জন্য বেতনা নদীর ৪৪ কিলোমিটার ও মরিচ্চাপ নদীর ৩৮ কিলোমিটার খনন ছাড়াও ৩৪৪ কিলোমিটার সংযোগ খাল খনন, ৬টি স্লুইসগেট নির্মাণ, ২১টি স্লুইসগেট সংস্কার ও ১১৩ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কার করা হবে। চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ১ জুলাই শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা।

বেতনা নদীর পাশের মাছখোলা গ্রামের বাসিন্দা মোকছেদ হোসেন জানান, ‘বৃষ্টি হলেই এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বছরের প্রায় ছয় মাস তাঁদের বাড়ির আঙিনাসহ রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে। রোদে না শুকালে পানি সরে না।’বেতনা নদীর আশাশুনি উপজেলার বাহদুরপুর গ্রামের আবদুল হাকিম বলেন, নদী কেটে খাল করা হচ্ছে। আগে নদী ছিল ৮০-৯০ ফুট। এখান তা ৪০-৫০ ফুট করা হচ্ছে। এরপর কাজ করা হচ্ছে ধীরগতিতে।

বেতনা রিভার বেসিন পানি কমিটির সভাপতি মো. মফিজুর রহমান বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে জরিপ করে সাতক্ষীরা জেলার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে খাল ও নদী খননের পাশাপাশি বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর অববাহিকার বিলে জোয়ারাধার (টিআরএম–টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্প থেকে জোয়ারাধার পদ্ধতি বাদ দিয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষে মানুষ সুফল পাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।