আগামী ১০ই নভেম্বরের মধ্যে পদত্যাগ করে জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আল্টিমেটাম দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সকল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। পাশাপাশি সংকট নিরসনে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কারারুদ্ধ শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ নেয়ারও দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন।
গতকাল বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে এসব ঘোষণা দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। এর আগে সকাল ১০টা থেকে সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বক্তব্য রাখেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুপুর ২টায় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্যে মহাসমাবেশ শুরু হয়।
‘বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে চলতি সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন এবং ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন বাতিল’র দাবিতে এই মহাসমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন।
সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, আগামী ১০ই নভেম্বরের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগ করে এবং জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে সকল নিবন্ধিত এবং প্রতিনিধিত্বশীল আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে কারারুদ্ধ বিএনপিসহ সকল শীর্ষ নেতাকে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকার এসব দাবি মেনে না নিলে আন্দোলনরত সকল বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তীতে কঠোর ও বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ও অবৈধ সরকারের পতনের লক্ষ্যে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সকল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করছি।
তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলতে চাই- আজকে আমরা তারিখ নির্ধারণ করেছি। আজকে আমরা এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে পরিষ্কার ঘোষণা করছি, যদি আপনি (প্রধানমন্ত্রী) জাতীয় সরকার এবং গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা না করেন, এখান থেকে ঘোষণা করছি- এবার জাতীয় নির্বাচন হবে না।
সরকারের উদ্দেশ্যে রেজাউল করীম বলেন, গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশ এবং যারা দাবি বাস্তবায়নে আওয়াজ তুলেছিলেন তাদেরকে নির্মূল করতে চায়। আজকে আমাদের বাস ও লঞ্চকে আটকে দেয়া হয়। আমরা সরকারকে বলছি, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের যে আটকে রেখেছেন- তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। মামলা দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে যারা ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাদের বাধা দিয়ে থামিয়ে রাখতে পারবেন না।
অবিলম্বে কারাগারে আটক বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, পাতানো দলীয় সরকারের অধীনে আপনারা জাতীয় নির্বাচন করবেন। আপনারা বলছেন যে, সংবিধানের বাইরে যাবেন না। সংবিধান তৈরি করেছিল কে? এই বর্তমান অবৈধ সরকার। এই অবৈধ সংবিধানের মাধ্যমে আজকে দেশের মানুষকে হত্যা করবেন। তাই দেশ আজকে ধ্বংসের পথে। সেজন্য ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য এবং দেশ রক্ষার জন্য আমাদের যদি জান দিতে হয়, রক্ত দিতে হয়- তার জন্য আমরা প্রস্তত আছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর বলেন, সরকারের ভয়-ভীতির মধ্যেও দেশের মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এজন্য রক্ত দিতেও তারা প্রস্তুত। এই ম্যাসেজ শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আজকে অবৈধ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে এই ম্যাসেজ পৌঁছাতে চাই। তারা বলছে যে, নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই করবেন। যা মন চায় তাই করবেন। দেশের মানুষ সেটা বসে বসে দেখবে। সেই ১৪ আর ১৮ সালের মতো নির্বাচন ২০২৪ সালের বাংলাদেশে হতে দেবে না জনগণ।
ফিলিস্তিনের হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, জাতিসংঘসহ বিবেকবান মানুষদের এর পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আর ইসরাইলকে বিতাড়িত করার জন্য আমরা এক সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই বলেন, দেশের মানুষ জালিম কর্তৃক নির্যাতনের শিকার। আমরা রক্তপাত চাই না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। এটা সংবিধানেও বলেছে। কিন্তু আমাদের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকা দিয়ে যে গুলি কিনেছে, সেই গুলি আমাদের বুকেই মারছে। এটা দেশের মানুষ সহ্য করবে না। অস্ত্র ভাণ্ডারে কতো গুলি আছে তা দেশের মানুষ দেখতে চায়। সুষ্ঠু নির্বাচন দিতেই হবে বলে সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, আর কতো লাশ পড়বে তা আমরা জানি না। এর হিসাব প্রধানমন্ত্রীকে মেলাতে বলবো। আর আমীর যে ঘোষণা দিবেন তা নিয়ে বাড়ি যাবো। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো। ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, এই সরকারকে আমরা ক্ষমতায় দেখতে চাই না। প্রস্তুত থাকবেন আমীর যে নির্দেশ দিয়েছেন তা আমরা সফল করবো।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, মহাসমাবেশে আসার জন্য আমাদের নেতাকর্মীদের জেলে যাওয়ার ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু যতই ভয় দেখাক আমরা এই সরকারকে উৎখাত না করে ঘরে ফিরে যাবো না। দুপুর ২টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মহাসমাবেশে যোগ দিতে ঢাকাসহ সারা দেশের হাজার হাজার নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকাসহ খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হন। সময় যতই বাড়ে নেতাকর্মীদের পদচারণায় সমাবেশস্থল ততই মুখরিত হয়ে উঠে। এ সময় নেতাকর্মীদের সরকার বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সমাবেশস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। পৌনে ১টার দিকে নামাজের জন্য সমাবেশে বক্তব্যে স্থগিত রাখা হয়। নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই জুমার নামাজ আদায় করেন। সোয়া ১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাটিতে চাদর, পাটি, গামছা এবং জায়নামাজসহ বিভিন্ন জিনিস বিছিয়ে নামাজ আদায় করেন নেতাকর্মীরা।
এদিকে শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত রাস্তায় বসে নেতাকর্মীরা বক্তব্য শোনেন। এ সময় এই রাস্তায় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশকে ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি সাদা পোশাকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
মহাসমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, প্রেসিডিয়াম সদস্য আল্লামা নুরুল হুদা ফয়েজী, নায়েবে আমীর খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মাওলানা আবদুল আউয়াল পীর সাহেব খুলনা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আল মোবারক, নায়েবে আমীর মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল হক আজাদ, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য চেয়ারম্যান মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আক্কাস আলী সরকার, আলহাজ আমিনুল ইসলাম, মুফতি এছহাক মোহাম্মদ আবুল খায়ের, যুগ্ম মহাসচিব ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সহকারী মহাসচিব হাফেজ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কেএম আতিকুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।