*ভোমরা স্থলবন্দরে সাড়ে ৩ কোটি টাকার স্বর্ণ জব্দ
*যে স্বর্ণ উদ্ধার হয় তার ২০ গুণ স্বর্ণ পাচার হয়
মুজাহিদুল ইসলাম, ক্রাইমবাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সাতক্ষীরা সীমান্ত। ১০ঘন্টার ব্যবধানে দুই দফায় ভোমরা স্থলবন্দরে সাড়ে ৩ কোটি টাকার সোনাসহ দুই পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি। সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ৬টি রুট স্বর্ণ পাচারে উল্লেখ যোগ্য রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো হলো সাতক্ষীরা সীমান্তের ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, ভোমরা, নোংলা ও কৈখালী। এসব সীমান্ত দিয়ে গত এক বছরে স্বর্ণ জব্দ হয়েছে ২৩ কেজি ৬০০ গ্রাম। শুধু ভোমরা ও বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্ত গত ২ বছরে স্বর্ণ জব্দ হয়েছে ২শ কেজি । এছাড়া দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের ১০টি জেলার শতাধিক চোরাচালান রুট যেন স্বর্ণের খনিতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের এসব রুটের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে বিভিন্ন পরিমাণের স্বর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় দেড় হাজার কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা থেকে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বিজিবি ৫৪ কেজি, ২০২০ সালে ৮৮ কেজি, ২০২১ সালে ৫০ কেজি ও ২০২২ সালে ১৯৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় ১৯০জন বাহককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে দেশে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি হয়েছে ১৪৮ কেজির মতো। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিজিবি বা কাস্টমসের হাতে যে স্বর্ণ উদ্ধার হয় তার ২০ গুণ স্বর্ণ পাচার হয়।
স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে ভারত অনেকটাই কঠোর। এ কারণে প্র চুর চাহিদা থাকার পরও দেশটিতে বৈধ পথে স্বর্ণের জোগান কম। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) বলছে, ২০২২ সালে ভারতে পাচার করা স্বর্ণের সম্ভাব্য পরিমাণ ১৬০ টন। অনেকে বলছেন, যে পরিমাণ চোরাই স্বর্ণ জব্দ হচ্ছে, এর কয়েক গুণ ফাঁকফোকর দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈধভাবে দেশে স্বর্ণ আসার পরিমাণ খুব বেশি নয়। ডলার সংকটের এ সময়ে স্বর্ণ চোরাচালান দেশের অর্থনীতিতেও ধাক্কা লাগাচ্ছে। কারণ, স্বর্ণ পাচারের অর্থ বিনিময় হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। অভিযোগ আছে, সোনা পাচারকারিরা আটক হলেও মূল মালিককে আটক করতে ব্যর্থ হয় বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন আইন প্র য়োগকারী সংস্থা। সোনা পাচারকারি চক্রটি দু’দেশেই অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় মূল মালিক থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অবৈধ অনুপ্র বেশকারি, দূরপাল্লার পরিবহন শ্রমিক, চেকপোস্টের বৈধ ও অবৈধ মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী, সিএন্ডএফ কর্মচারি ও পাসপোর্টধারী যাত্রীদের মাধ্যমে সীমান্ত পথে সোনা পাচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাচারকারিদের কেউ কেউ আটক হলেও পর্দার আড়ালে থেকে যায় প্রকৃত চোরাকারবারিরা। গোপন সংবাদ ছাড়া কোন অবস্থাতেই সোনার চালান আটক করা সম্ভব হচেছ না বলে আইন প্র য়োগকারী সংস্থা থেকে অভিযোগ করা হয়।
তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সীমান্তে একের পর এক স্বর্ণ উদ্ধার ও জব্দের ঘটনা ঘটছে। কখনো গাড়িতে বিশেষ কায়দায়, কখনো পেটের ভেতর বা পায়ুপথে, নারীদের গোপনাঙ্গে, স্যান্ডেল-জুতার ভেতরে বিভিন্ন কায়দায় স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে স্বর্ণ পাচারে কৃষক, দিনমজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা থেকে সড়ক পথে বা ট্রেনে করে একজন বাহক স্বর্ণের চালান সীমান্ত এলাকার নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। বাহকরা টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রেখে সেগুলো বহন করেন। বিজিবির দেয়া তথ্যমতে, খুলনা বিভাগের ছয় জেলা সাতক্ষীরা, যশোর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ও ঝিনাইদহ স্বর্ণ জব্দ বেশি হয়ে থাকে।
বিজিবি বলছে, পাচার প্রক্রিয়ায় তারা ব্যবহার করে বেশ কিছু কৌশল ও সাংকেতিক কোড। চক্রের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা জানে না একে অন্যের নাম-পরিচয়। যখন হাতবদলের সময় হয়, তখন যে ব্যক্তির কাছে চালান পৌঁছাতে হবে শুধু তার কাছে থাকা নির্দিষ্ট একটি টাকার নোটের সিরিয়াল নম্বর হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাহককে জানানো হয়। কখনও কখনও বলা হয়, যে ব্যক্তি ছেঁড়া টাকার নোট দেখাবে, তার হাতেই যাবে স্বর্ণ। যেসব স্পটে স্বর্ণ হাতবদল হয়, এর আশপাশে নজরদারিতে থাকে আলাদা আরেকটি গ্রুপ। আসল ব্যক্তির কাছে চালান পৌঁছাচ্ছে কিনা, তা তদারকিতে থাকে তারা।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে ১০ঘন্টার ব্যবধানে দুই দফায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার সোনাসহ দুই পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ভোমরার স্থলবন্দর সংলগ্ন লক্ষীদাড়ী সীমান্ত থেকে ২ কোটি ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ১০ পিস সোনার বারসহ মো. সাইফ উদ্দিন (২৩) নামে একজনকে আটক করে বিজিবি। সাইফ উদ্দিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লক্ষীদাড়ী গ্রামের কবির সরকারের ছেলে। বিজিবি সাতক্ষীরা ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আশরাফুল হক স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। লে. কর্ণেল আশরাফুল হক জানান, সোনার বারগুলো সাতক্ষীরা ট্রেজারি অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে ও আটকদের থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশরাফুল হক জানান,জানিয়েছে, আজ যে টেকনোলজি মর্ডান মনে হচ্ছে, ঠিক আগামীকাল সেটা পুরাতন হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে চোরাকারবারিরা তাদের কাজ করেন। তাদের গ্রেপ্তার করার পর কৌশলও পাল্টে ফেলেন। এ কারণে বিজিবিকে প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করতে হয়। সীমান্তে সোনা, মাদক, অবৈধ পন্য পাচার প্রতিরোধে বিজিবি কাজ করছে।