জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও থেমে নেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়। প্রতিদিনই সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত ও যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর নেতাদের বাড়ি বাড়ি। নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পরিবারের স্বজন, গাড়িচালক, ব্যক্তিগত সহকারী, অফিসের স্টাফদের। গ্রেপ্তার এড়াতে ঘরছাড়া দলটির লাখো নেতাকর্মী। তারা রাত কাটান বাড়ির বাইরে জঙ্গলে, ধানক্ষেতে, নৌকায় মাঝনদীতে, পুকুরের মাচায়। তফসিল ঘোষণার দিন থেকে গত চারদিনে বিএনপি’র দেড় সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই নাশকতার মামলার আসামি। বিরোধী জোটের চলমান হরতাল-অবরোধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে।
গত বৃহস্পতিবার যশোরে একটি গ্রেপ্তারের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। ওইদিন রাতে অসুস্থ মা ও সন্তানকে দেখতে বাড়িতে আসার পর গ্রেপ্তার করা হয় যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিফতাহ উদ্দিন শিকদারকে। গ্রেপ্তারের সময় পুলিশের কাছে হাতজোড় করে কাকুতি-মিনতি করে ওই যুবদল নেতা বলেন, আমার মা অনেক অসুস্থ, আমার ছেলে অসুস্থ, আমাকে নিয়েন না, আমাকে ছেড়ে দেন।
মিফতাহকে গ্রেপ্তারের একটি ভিডিও শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। ব্রেইন টিউমারের অস্ত্রোপচার করা বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম পটু অসুস্থ অবস্থায় আদালতে হাজিরা দিতে গেলে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৭ বছরের আবদুল সামাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সিলেটের মোগলা বাজার থেকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সামাদের মা রাফিয়া আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী ব্রেইন স্ট্রোক করে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর ছেলে সিএনজি চালিয়ে সংসার চালাতো। মামার বাড়ি যাওয়ার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। আমার ছেলে কোনোদিন কোনো দলের মিছিলে গেছে, সেটা এলাকার কেউ বলতে পারবে না। স্বামী অসুস্থ হওয়ায় এখন ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি।
এদিকে বিএনপি’র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও উপজেলার মিছিল থেকে জামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ফজলে রিমন ভূঁইয়া, যাত্রাবাড়ী থানা বিএনপি নেতা মো. রহমত উল্লাহ, কদমতলী থানাধীন ৬১নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরনবী সবুজ পাশা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ফরিদ উদ্দিন রায়হান, মোহাম্মদপুর থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আইয়ুব আলী, যশোর জেলার বাঘারপাড়া পৌর যুবদলের আহ্বায়ক হিরু আহমেদ এবং মঙ্গলকোর্ট ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি আব্দুল গনি বিশ্বাস, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মোকাররম হোসেনসহ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি বাচ্চু আহমেদ, পানছড়ি উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক দিদারুল আলম, ৫নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি মো. আবুল কাশেম, সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জুলফিকার আলী, যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাজিদুর রহমান, ৭নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সহ-সভাপতি মো. আবু দাউদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. মিরাজ মজুমদার আকাশ, উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মো. আল-আমিন সরকার পাপ্পু ও ইউনিয়ন যুবদল নেতা মো. আরাফাত হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পাবনার দুলাই ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আজম আলী খান ও সাঁথিয়া উপজেলার যুবদল নেতা বেলাল হোসেনকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সাতক্ষীরার পৌর যুবদলের সদস্য সচিব মাসুদ রানা এবং বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবক দলের ঢাকা মহানগর উত্তর শাহ আলী থানার নেতা মো. জুয়েল, গাজীপুর জেলা কালিয়াকৈর পৌর ৮নং ওয়ার্ড সদস্য সচিব কবির সরকার, মানিকগঞ্জ জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রিপন হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর চান্দগাঁও থানা সদস্য নজরুল ইসলাম বক্কন, ৩৮নং দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ড নেতা রাসেল, বগুড়া জেলাধীন ১৬নং ওয়ার্ড যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সোহেল হোসেন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা মিরসরাই পৌর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আব্দুল্লাহ আল ফয়সালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মহানগর পতেঙ্গা থানা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ লোকমান, মো. ফোরকান, চট্টগ্রাম মহানগর পতেঙ্গা থানা কৃষক দলের সদস্য সচিব মো. সাইফুল ইসলাম, মগুরা জেলাধীন শ্রীপুর উপজেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকরাম হেসেন, মাগুরা সদর জগদাল ইউনিয়ন কৃষক দলের সহ-সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, মাগুরা সদর থানার মগি ইউনিয়ন কৃষক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নায়েব আলী, রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক হোসেন, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন কৃষক দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুর রহিম, গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন কৃষক দলের সভাপতি আল-আমিন এবং রংপুর সদর ৪নং চন্দনকাঠ ইউনিয়ন কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইউসুফ মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শুক্রবার তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মাজদুক হাসান শ্রাবণকে উত্তরা থেকে তুলে নিয়ে গেছে ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া টাঙ্গাইল শহর ছাত্রদলের আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম ইমন, পবা উপজেলা ছাত্রদল নেতা তাফসির হোসেন, ফরিদপুর শহর ছাত্রদল নেতা সুজন, যশোর জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মিফতাহ উদ্দিন শিকদার এবং ৭নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি আল-আমিন অভিকে না পেয়ে তার ভাতিজা (এসএসসি পরিক্ষার্থী) সোহান সরকারকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ।
নেতাদের না পেয়ে স্বজনদের গ্রেপ্তার: অভিযানকালে নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পরিবারের স্বজন, গাড়িচালক, ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে। গত শুক্রবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ছেলে তানভীর রহমান মিথুনের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। এর আগে শিমুল বিশ্বাসের পাবনার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তাকে না পেয়ে তার ছোটভাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চট্টগ্রাম জেলাধীন ভুজপুর থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক একরামুল হককে বাড়িতে না পেয়ে তার বড় ভাই এমদাদুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মো. এলাহির বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। তাকে না পেয়ে তার কলেজপড়ুয়া ছোট ভাই মো. শাকিল আহমেদ (১৮)কে তুলে নিয়ে যায় তারা। কেশবপুরের পাজিয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা রিপনকে না পেয়ে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া বরগুনা জেলা আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনিরকে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। নওগাঁ জেলা যুবদলের আহ্বায়ক মো. মাসুদ হায়দার টিপুকে মারধর করে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নবীনগর উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব কাওছার মিয়ার বাড়িতে হামলা চালিয়ে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে পুলিশ।
ঘরছাড়া লাখো নেতাকর্মী: ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতাকর্মীরা অন্য এলাকায় আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে বাড়ির আশপাশে বনে-জঙ্গলে, ধানক্ষেতে, নৌকায় মাঝ নদীতে, পুকুর পাহারা দেয়ার মাচায়, মানুষের রান্নাঘরে আত্মগোপনে থাকছেন। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, খুলনা বরিশাল জেলার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি’র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, শুধুমাত্র তফসিল ঘোষণার দিনই বিএনপি’র ৩৪৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এ সময়ে মামলা করা হয়েছে ৯টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১১৩৫ জনকে। তফসিল ঘোষণার পর দিন সারা দেশে বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ৪৯০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, এ সময়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে ১২টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৩৭০ জনকে এবং গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয় ৩৯৫ জনকে, মামলা দায়ের করা হয়েছে ৮টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১০৬৫ জন নেতাকর্মীকে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৩১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মামলা দায়ের করা হয়েছে ৭টি এবং এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯৭৫ জন নেতাকর্মীকে।
এ ছাড়া ২৮শে অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত ১৩,২১০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলা হয়েছে ২৯৬টি। আহত হয়েছেন ৪১৩৩ জন নেতাকর্মী। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। ১৮টি মামলায় ৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও ১৩৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এদিকে শুক্রবার বিকাল থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত সারা দেশে জামায়াতের ২৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় একজনকে। আর গত ২৫শে অক্টোবর থেকে ১৮ই নভেম্বর পর্যন্ত ২৩১৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দলটির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মানবজমিনকে বলেন, ইসি আরও একটি পাতানো নির্বাচন করতেই এই তফসিল ঘোষণা করেছে। আর একতরফা নির্বাচন করার জন্য তফসিলের পরও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় করা হচ্ছে।