বিতর্কিত নূরুল হুদা কমিশনের পথেই হাঁটছে আউয়াল কমিশন। হুদা কমিশনের ডিজাইনে কিছু সংযোজন , বিয়োজন করে এগুচ্ছেন তারা । ইতিমধ্যে তার কিছু আলামতও প্রদর্শন করা হয়েছে । সরকার গত ছয়মাস ধরে মাঠপর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসনকে যেভাবে সাজিয়ে ছিলো তা বহাল রাখা হবে বলে ইতিমধ্যে একজন কমিশনার ঘোষণা দিয়েছেন ।অর্থাৎ পুনরায় ক্ষমতায় আসতে মরিয়া যে রাজনৈতিক দল তার সরকারের সাজানো প্রশাসন দিয়েই নির্বাচন আয়োজন করবে ইসি। শুধু তাই নয়, নির্বাচনে যে কোনো ধরনের কারচুপি যেন জনসস্মুখে প্রকাশিত না হয় সেজন্য ফেসবুকসহ ইন্টারনেট বন্ধের ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে । ভোট কেন্দ্রে কোনো ভোটার মোবাইল ফোনও নিয়ে যেতে পারবেন না। কেন্দ্রের ভিতর থেকে সবুজ সিগন্যাল না আসা পর্যন্ত গণমাধ্যম এবং পর্যবেক্ষকদের কাউকে ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হবে না ।
এক সপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলো নির্বাচন কমিশন । তফসিল ঘোষণার আগে খোদ নির্বাচন কমিশনই জানিয়েছিলো, নির্বাচনের কাঙ্খিত যে পরিবেশ তা এখনো সৃষ্টি হয়নি ।
তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ইসিকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি । সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মধ্যে যে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা রয়েছে তা দূর করতে ইসি কোনো ভূমিকা নেয়নি । খোদ সরকারের সহযাত্রী সংসদের একমাত্র বিরোধীদল জাতীপার্টি এখনো বলছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো ফিরে আসেনি । ১৪ দলের শরিকদলগুলো ছাড়া নিবন্ধিত প্রায় সকল দলই একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন । অতীতে ভোট গ্রহণের ৪২ দিন থেকে ৪৫ দিন আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতো । বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি । ভোট গ্রহণের পর গেজেট প্রকাশ এবং নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার জন্য এক সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্য তফসিল ঘোষণা করা যেত । কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে সংলাপ আহ্বানের চিঠি দেয়ার পরই তড়িঘড়ি করে তফসিল ঘোষণা করে ইসি । এতে সংলাপের যে সম্ভবনা ছিলো তাও পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দেয়া হয় । ইসির তফসিল ঘোষণার দোহাই দিয়ে সংলাপের আহ্বান নাকচ করে দেয় সরকারি দল । পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, সরকার চেয়েছে বলেই নির্বাচন কমিশন বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণা করেছে। এরমধ্য দিয়ে ইসি সরকারি দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলকে সহায়তা দিয়েছে । সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনও মঙ্গলবার এক ওয়েবিনারে বলেছেন, ইসি নিজে থেকে এই তফসিল দিয়েছে কি না সন্দেহ রয়েছে । এই আস্থাহীনতার মধ্যেও নিয়োগ পাওয়ার পর নানান ধরনের আশার বাণী শুনিয়েছিলো এই কমিশন ।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়ে কয়েকদফা শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। দু’দফা বৈঠক করে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের সাথেও । এসব বৈঠক পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে ইসি। যেসব বিষয়ে ইসি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগ , সিসিটিভির ব্যবহার ইত্যাদি ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগেরও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন । গত ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার আলমগীর হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন , তফসিল ঘোষণার পর আগের কিংবা পরের কোনো মামলায় আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা ব্যতিত কাউকে গ্রেফতার না করতে তারা পুলিশকে নির্দেশনা দিবেন । কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাদের আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ গ্রেফতার করছে । অসংখ্য মামলায় এজাহারে নাম না থাকা স্বত্বেও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে । এ বিষয়ে কমিশনের কোনো পদক্ষেপ নেই । কমিশন এখন বলছে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হবে শুধু তাদের দায়িত্ব তারা নিবে । কিন্ত নির্বাচনের জন্য যে একটা সুষ্ঠু পরিবেশ এবং তারা যে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সক্ষমতা প্রদর্শনের যে একটি ব্যাপার ছিল সেটি বুঝতে তারা অক্ষম ।
অতীতে যেকটি নির্বাচন তুলানামূলকভাবে সুষ্ঠু হয়েছে এবং জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে, গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তার সবকটি নির্বাচনের আগে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছিলো । একটি দলীয় সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন তার মতো করে প্রশাসনকে সাজিয়ে রাখে ।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন সামনে রেখে গত জুন-জুলাইয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের বড় ধরনের রদবদল করে সরকার । গত ১১ মাসের ব্যবধানে সরকার ৯ বিভাগীয় কমিশনার, ১৮ জন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, ৬৮ নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৪৫ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), ২২১ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের ১৬ জন ডিআইজি, ৩৫ জন অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ২৮ জেলার এসপি পদে রদবদল করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার অধিকাংশ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়েছে। এছাড়া ডিসির ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪, ২৫ এবং ২৭ ব্যাচের আরও শতাধিক কর্মকর্তাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে কয়েকটি স্তরে প্রশাসনকে সাজিয়ে রেখেছে । এ নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে । কিন্তু বর্তমান সরকার তফসিল ঘোষণার আগে প্রশাসনকে যেভাবে সাজিয়েছে সেটা ঠিক রেখেই নির্বাচন করতে যাচ্ছে আউয়াল কমিশন ।
নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন পুলিশ ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের এই কর্মকর্তারা। বিশেষ করে ডিআইজি , জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) এবং পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। এর মধ্যে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠপর্যায়ে তারাই নির্বাচনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন । ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাতের ভোট আয়োজনসহ বিরোধদলীয় নেতা কর্মীদের হয়রানী এবং নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছিলো প্রশাসনের বিরুদ্ধে । বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের সংলাপেও ব্যাপক আলোচিত হয় । গত বছরের সেপ্টেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সেখানে তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ১৪টি চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করেছিল। এর দ্বিতীয়টি ছিল ‘নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মাঠ প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার তার সবগুলো টুলস ব্যবহার করা হবে । কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর সাত দিন অতিবাহিত হলেও মাঠ প্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি । বরং উল্টো সুর পাওয়া গেছে । এখন বলা হচ্ছে, নির্বাচনকালে কোথাও কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সেখানে ব্যবস্থা নেয়া বা রদবদল করার বিষয়টি কমিশন দেখবে। সেক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে প্রমাণ দাখিল করতে হবে । ২০১৮ সালে এই সুরেই কথা বলেছিলেন সাবেক সিইসি নুরুল হুদা । তিনি যেভাবে সরকারের সাজানো পথে নির্বাচন করেছিলেন একই পথ অনুসরণ করছেন তারা।
যদিও ইসি তাদের কর্মপরিকল্পনায় এবার যতদূর সম্ভব নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার কথাও বলেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসির নিজেদের কোনো কর্মকর্তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়নি। মতবিনিময় সভায় সাবেক সিইসিরা একজন রিটানিং অফিসারের অধীনে ২টির বেশি আসন না দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন । ইসি তাদের নিজস্ব কর্মকতাদের বসিয়ে রেখে একজন জেলা প্রশাসকের কাছে জেলার সকল আসনের দায়িত্ব দিয়েছে । এর ফলে কোনো কোনো জেলার ডিসিকে ৮/১০ আসনের রিটানিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হবে ।
এছাড়া নূরুল হুদার কমিশনের সময় যারা প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের প্রায় সকলকেই এবারও ভোটগ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে । এই কর্মকর্তারাই রাতের ভোটের অংশীদার ছিলেন ।
নির্বাচন কমিশন যে সরকারের সঙ্গে যোগসাজসে একটি নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে তার বড় প্রমাণ হলো কিংস পার্টি খ্যাত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়া । বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধন না দিয়ে কমিশনের বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নামে দুই রাজেনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয় ইসি । রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন রয়েছে বিভিন্ন সংস্থা এই দলগুলো সৃষ্টি করেছে । তাদের নিবন্ধন দেয়া হয়েছে বিএনপি নেতাদের নানা প্রলোভনে বাগিয়ে নিয়ে এ দল দুটি থেকে নির্বাচন করার জন্য । যার আলামত ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে । অথচ দেশের কোথাও
বিএনএমের কোনো কমিটি নেই । এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটিও নেই । সেদিন সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি থেকে বাগিয়ে নেয়া একজনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে । আর সভাপতি নাকি কিছুদিন পর বিএনএমে যোগ দিবেন । কৌতুকপ্রদ এসব ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন সংস্থা এবং ইসির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রযোজনা এবং পরিবেশনায়।