অনিয়ম ও অবব্যস্থনাকে দায়ী করছে দুবলাপল্লীর জেলেরা
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবব্যস্থনার কারণে অফুরন্ত সম্ভাবনাময় শুঁটকি শিল্পে কাঙ্খিত সফলতা মিলছে না। বছরের পর বছর নিরলস পরিশ্রম করে গেলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি জেলেদের। এর পরও সুন্দরবনের দক্ষিণে অবস্থতি দুবলার চরের অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীতে শুরু হয়েছে মাছ শুঁটকির এক মহাকর্মযজ্ঞ। চলবে ৫ মাস ব্যাপি। মাছ ধরা, বাছাই, গ্রেডিংসহ প্রক্রিয়াজাত করনে বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েক হাজার জেলে। ধু-ধু বালুকাময় সৈকত মারিয়ে জেলেরা সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে ফিরছে শুঁটকি পল্লীতে। তবে চরগুলোতে উন্নত পরিবেশ না থাকার পাশাপাশি নানা অব্যবস্থাপনার কারণে মান সম্পন্ন শুটকি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। খ্যাতটি যেন অনিয়মের বেড়াজালে আটকে গেছে। ব্যবসায়ীদের মতে উন্নতমানের শুটকি উৎপাদন করা গেলে সরকারি রাজস্ব বহুগুনে বেড়ে যাবে এবং দুবলার চরে তৈরি শুটকি বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব হবে। শুঁটকি পল্লীতে জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য এবছর ১ হাজার ১০৮টি ঘর, ৭৮টি ডিপো এবং ৯৬টি দোকান স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ। শুঁটকি থেকে এবার ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ।
সাগর থেকে মাছ ধরে জেলেদের ফিরে আসার দৃশ্য ও শুঁটকি তৈরি এবং বেচা বিক্রির দৃশ্য সত্যিই মনোলোভা ও উপভোগযোগ্য। বর্ণনাতীত এ অপার্থিব দৃশ্য সুন্দরবনের দুবলার চরের জেলে পল্লী ছাড়া আর কোথাও মেলা ভার! বঙ্গোপসাগর উপকূলে দুবলারচর, আলোরকোল, নারকেল বাড়ীয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চর নিয়ে সুন্দরবনের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক মাছ শুঁটকি পল্লী কেন্দ্র দুবলার অবস্থান। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে এ চরগুলো অবস্থিত।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখে গেছে, সাগর থেকে ধরে আনা মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে এ পল্লীতে। বাঁশের মাঁচা করে ও পাটিতে খোলা আকাশের নিচে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। এখানে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা ভীষণ মুগন্ধতা নিয়ে শুঁটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গোঁপসাগরের মোহনায় দুবলার চর, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, শেলারচর ও মাঝের কিল্লাসহ ৫/৬ টি চরে কয়েক যুগ ধরে চলছে সুটকি উৎপাদনের কার্যক্রম। এই এলাকাটি দুবলা শুটকি পল্লী নামে পরিচিত। প্রতি বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পাঁচ মাস চালু থাকে শুটকির এ মৌসুম। এ সময় উপকুলীয় এলাকা সাতক্ষীরার আশাশুনি, দেবহাটা, শ্যামনগর, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রা, বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা এবং পটুয়াখালী, চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার জেলে ও ব্যবসায়ী এ সকল চরে শুটকি তৈরি ও সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
শুটকি পল্লীর জেলে ও মহাজনদের কয়েকজন বলেন, দুবলা শুটকি পল্লী এলাকায় কর্মকতা, বন কর্মকর্তারা জেলে ও মহাজনদের নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে নানাভাবে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন । এছাড়া প্রতিটি ট্রলার থেকে ১৪/১৫ হাজার টাকা রাজস্ব হিসেবে নিয়ে মাত্র ৫/৬ হাজার টাকার রাজস্ব গ্রহণের রশিদ দিচ্ছেন বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা। এবাদে জেলে ও তাদের মহাজনদের নিকট থেকে বিভিন্ন কায়দায় আদায়কৃত অনেক টাকার কোনো রশিদই দেওয়া হয় না। এভাবে সরকারি রাজস্ব কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
সুপেয় পানি, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যায় সুন্দরবনের দুবলা শুটকি পল্লীর প্রায় ২৫ হাজার জেলে। বন বিভাগের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আজও মেলেনি কাংখিত সেবা। এমন অবস্থায় সুন্দরবনের দুবলারচরের শুঁটকি পল্লীর জেলেদের পানির চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে খেতে হয় মাটির গর্ত খোড়া কুয়ার পানি আর অসুস্থতায় ভরসা ফার্মিসীর চিকিৎসা।জলেরা বলছে, শুঁটকি মৌসুম সামনে রেখে প্রত্যেক জেলেকে মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়। এই টাকা দিয়ে জাল কেনা, নৌকা মেরামত ইত্যাদি কাজ চলছে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে এরইমধ্যে। কিন্তু দিনে দিনে শুঁটকি উৎপাদনে যে বিপদ বাড়ছে, তাতে এই পেশায় টিকে থাকা নিয়েই তার শংকায়।
বন বিভাগের দুবলা জেলে পল্লী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, মৌসুমের শুরুতে বন মন্ত্রণালয় শুঁটকি মাছের ওপর বর্ধিত শুল্ক নিয়ে একটি সার্কুলার জারি করায় গতবছর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “গতবছর দুবলায় ৬ কোটি ৬৮ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে, যা অতীতের যেকোনো মৌসুমের চেয়ে বেশি। আর চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি রাজস্ব আরো বাড়তে পারে।