যশোরে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার যুবদলের এক নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পেশায় কলেজশিক্ষক ওই যুবদল নেতা কারাগারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের শয্যায় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। খাওয়ার সময়ও তাঁর হাতকড়া খোলা হয়নি। এমনকি স্বজনদের সঙ্গে তাঁকে দেখা করতেও দেওয়া হয়নি।
যুবদলের ওই নেতার নাম আমিনুর রহমান। তিনি যশোর জেলা যুবদলের সহসভাপতি ও সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের আমদাবাদ কলেজের প্রভাষক। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডান্ডাবেড়ি পরা তাঁর একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার কলেজের একজন শিক্ষকের সঙ্গে দাগী আসামির মতো ব্যবহারকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
হাতকড়া-ডান্ডাবেড়ি নিয়েই মায়ের জানাজা পড়লেন বিএনপি নেতা
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরাপত্তার স্বার্থে কারাবিধি অনুযায়ী ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো বিষয় নেই। যদি কোনো আসামি অসুস্থ হন, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীর পরিবার ও কারা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে যশোর কোতোয়ালি থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি মামলা করে পুলিশ। ২ নভেম্বর সদর উপজেলার আমদাবাদ কলেজ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর কারাগারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে এবং পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এ সময়ও তাঁর পায়ের ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। এমনকি খাওয়ার সময়ও হাতকড়া খুলে দেয়নি পুলিশ। রোগীর সঙ্গে স্বজনদের ঠিকমতো দেখা করতেও দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
এবার শরীয়তপুরে হাতকড়া-ডান্ডাবেড়ি নিয়ে মায়ের জানাজায় ছাত্রদল নেতা
আমিনুরের স্ত্রী নাহিদা সুলতানা ওরফে লাবণী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী নাশকতার কোনো ঘটনায় জড়িত নন। কলেজ থেকে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি একজন শিক্ষক। রাজনীতি করায় পুলিশ হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে ভয়ংকর দাগী আসামির মতো আচরণ করেছে। হৃদ্রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী কি দৌড়ে পালাতে পারেন? অথচ তাঁর ডান্ডাবেড়ি খুলে দেয়নি। হাতকড়া পরা অবস্থায় ভাত খেতে দিয়েছে।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আমিনুরের সংসার। ১৬ বছর বয়সী কিশোর ছেলে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। মেয়েটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। নাহিদা সুলতানা বলেন, ‘আমি হাসপাতালেই ছিলাম। কিন্তু পুলিশ রোগীর কাছে যেতে দেয়নি। খাবার, ওষুধও ঠিকমতো দিতে দেয়নি। মাঝেমধ্যে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে খাবার দিয়েছি। আমরা অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আমাদের কান্না দেখার কেউ নেই। আমরা খুবই অসহায় অবস্থায় আছি। ছেলেটার সামনে পরীক্ষা। বাবার টেনশনে সে পড়ায় মন বসাতে পারছে না। এখন কী করব, বুঝতে পারছি না।’
মায়ের জানাজায় হাতকড়া-ডান্ডাবেড়ি পরানোকে ‘অমানবিক’ বলল মানবাধিকার কমিশন
হাসপাতালের শয্যায় চিকিৎসাধীন আমিনুরের ডান্ডাবেড়ি পরা একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে মন্তব্যের ঘরে বিএনপির নেতা-কর্মীসহ অনেকেই নানা ধরনের মন্তব্য করছেন। জানতে চাইলে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম বলেন, তাঁর জানামতে আপিল বিভাগের একটি নির্দেশনা ছিল, খুনের আসামি বা ভয়ংকর জঙ্গি ধরনের আসামিদের ক্ষেত্রে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আমিনুর একজন কলেজশিক্ষক। তাঁর সামাজিক মর্যাদা আছে। শুধু বিএনপি করায় তাঁর সঙ্গে দাগী আসামির মতো আচরণ করেছে পুলিশ। কোনো রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে সরকার এমন আচরণ করতে পারে না। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত রূপ। এমন আচরণ তাঁর সঙ্গেও হতে পারে।
এ ব্যাপারে যশোর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হুসাইন বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. শরিফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আমিনুর রহমান কারাগারে আসেন। তাঁর হার্টে আগেই রিং পরানো ছিল। কারাগারে আসার পর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসার পর আজ মঙ্গলবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে যশোরে পাঠানো হয়েছে।
ডান্ডাবেড়ি পরানো সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী
ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়ে শরিফুল আলম বলেন, কারাগার থেকে যখন কোনো আসামিকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে কারাবিধি অনুযায়ী ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। যদি কোনো আসামি অসুস্থ হন, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো বিষয় নেই।
এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বিএনপির এক নেতা কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে মায়ের জানাজায় অংশ নিতে এসেছিলেন। তখন তাঁর ডান্ডাবেড়ি পরে মায়ের জানাজা পরানোর ছবি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। এরপরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটিকে ‘অমানবিকই নয়, বরং মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী’ বলেছিল।
আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির নয়: হাইকোর্ট
যশোরের মানবাধিকার সংগঠন ‘রাইটস যশোর’-এর প্যানেল আইনজীবী মীর ফিরোজ হাসান বলেন, পা থেকে কোমর পর্যন্ত ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাসপাতালে কোনো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। তা ছাড়া ওই ব্যক্তির আগেই বাইপাস সার্জারি করা হয়েছে। এমন অবস্থায় তাঁর ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।