নির্বাচনের উত্তেজনা মনোনয়নেই শেষ?

তপশিল না পেছালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি। পেছানোর কথা এলো, কারণ নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিএনপি এলে প্রয়োজনে তপশিল পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। তবে সর্বশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, বিএনপির নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা নেই। তার মানে ঘোষিত তপশিলেই নির্বাচন হচ্ছে। আর ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জানা যাবে কারা পাচ্ছে পরের পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। তবে এটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলাদেশের শিশুটিও জানে, বিএনপি না এলে আওয়ামী লীগই টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসছে। আরেকটা বিষয়ও নিশ্চিত করেই বলা যায়, বিএনপি না এলে আগামী নির্বাচন হবে নিরুত্তাপ, একতরফা।

দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা যেটুকু ছিল তা ফুরিয়ে গেছে ২৫ নভেম্বরই। সেদিন বিকেলে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল আগামী নির্বাচনের জন্য ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। কারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন, তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই কৌতূহল ছিল, সম্ভাব্য প্রার্থীদের উৎকণ্ঠা ছিল। ৩০০ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ৩ হাজার ৩৬২ জন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। গত কয়েক দিন আগ্রহী প্রার্থীরা ঢাকায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন। মনোনয়ন পেতে তদবির করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায়। তবে আমার ধারণা, শেষ মুহূর্তের এই দৌড়ঝাঁপে কোনো কাজ হয়নি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড বসে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বটে, তবে আমার ধারণা, শেখ হাসিনা অনেক আগেই মনোনয়ন তালিকা তৈরি করে রেখেছিলেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ, ব্যক্তিগত প্রজ্ঞায় শেখ হাসিনা নিজের মতো একটি তালিকা আগেই করে রেখেছিলেন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, শেখ হাসিনার টেবিলে একটি নয়, অন্তত চারটি তালিকা ছিল। বিএনপি এলে একরকম, ১৪ দলের সঙ্গে জোটগত নির্বাচন হলে একরকম, জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটগত নির্বাচন করলে একরকম, নবগঠিত একাধিক কিংস পার্টি ও সমমনা দলগুলোর জন্য আসন ছাড়লে একরকম।

সব হিসাব-নিকাশ চুকেবুকে গেছে ২৫ নভেম্বর শনিবার। সেদিন সকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আগ্রহী প্রার্থীদের ডেকে নির্বাচনের নির্দেশনা দিয়েছেন। বিকেলে ওবায়দুল কাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। জাসদের হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমানের আসন দুটি ফাঁকা রেখে ২৯৮ আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। তাহলে কি আওয়ামী লীগ এবার একাই নির্বাচন করবে? তাহলে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, বিকল্পধারা, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, যুক্তফ্রন্ট বা ইসলামী দলগুলোর কী হবে? নিজের যোগ্যতায় জাতীয় পার্টি হয়তো কয়েকটি আসন পেতে পারে। নির্বাচনে যাওয়া বাকি কোনো দলেরই তো কোনো আসনে এককভাবে জেতার মুরদ নেই। তাহলে এদের ভবিষ্যৎ কী? প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে আওয়ামী লীগ হয়তো সবাইকে আলাদা নির্বাচনে উৎসাহিত করবে। আনুষ্ঠানিক জোট না হলেও তলে তলে হয়তো সমঝোতা হবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত এসব নাটকীয়তা চলতেই থাকবে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী বর্তমান মন্ত্রিসভার তিন প্রতিমন্ত্রীসহ বর্তমান সংসদের ৭১ জন এমপি এবার মনোনয়ন পাননি। আর গত বছরের প্রাথমিক তালিকা ধরলে ১০২ জনই নতুন মুখ। তার মানে একটা শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই চূড়ান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ। এটা মানতেই হবে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা নিজেকে তুলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে। বাংলাদেশে উন্নয়ন হয়েছে অভাবনীয় গতিতে। সত্যি বলতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। এত উন্নয়নের পরও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। একটি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরা অনিশ্চিত হয়ে যাবে। এর দায় শেখ হাসিনার নয়, দলের এমপিদের। গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপিদের জিততে জনগণের ভোট লাগেনি। তাই তারা নির্বাচনের আগে বা পরে জনগণের কাছে যাননি। এবারও তারা বসে আছেন, শেখ হাসিনা কোনো না কোনোভাবে তাদের জিতিয়ে আনবেন। এমপিদের এই জনবিচ্ছিন্নতা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে। অথচ তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামোই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এবং এমপিদের জনবিচ্ছিন্নতা সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এ ঝুঁকি থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হয়তো এবার নতুন মুখের ছড়াছড়ি। নতুন প্রার্থীকে অন্তত আগের এমপির জনবিচ্ছিন্নতার দায় বহন করতে হবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, মাত্র ৭১ জন এমপিকে বাদ দিয়েই এ ক্ষত পুরোপুরি মেরামত সম্ভব নয়। জনবিচ্ছিন্ন এবং আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর আরও অনেকে আছেন মনোনয়নের তালিকায়। হয়তো একতরফা নির্বাচনের সুবিধা নিয়ে তাদের অনেকে আবারও নির্বাচিত হবেন। তাতে একটা জনপ্রিয়তার বিভ্রম তৈরি হবে। নির্বাচিত হলেও তাদের অনেকেই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নন। আওয়ামী লীগের সমস্যাটা হলো, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ক্ষমতালোভী অনেক হাইব্রিড ভিড়ে গেছেন দলে। তারা অন্তরে আওয়ামী লীগকে ধারণ করেন না। কয়েক দিন আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেককেও শোকগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। হাইব্রিডদের দাপট তো আছেই, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় ত্যাগী আওয়ামী লীগারদের গায়েও অনেক চর্বি জমে গেছে। আওয়ামী লীগের এমপিদের অনেকে নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে এমপি লীগ গড়ে তুলেছেন। এমপি লীগের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগারদের অবস্থা বিএনপির চেয়েও খারাপ।

এবারের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে আমলাদের প্রাধান্য বেড়েছে। সুখের কথা হলো, ব্যবসায়ীদের দাপট কিছুটা কমেছে। তবে মনোনয়নে পারিবারিকীকরণ চোখে লেগেছে। হাজী সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মতিউর রহমান, এইচ এন আশিকুর রহমান, দবিরুল ইসলামের আসনে ছেলেরা মনোনয়ন পেয়েছেন। আগে-পরের হিসাব করলে এ তালিকাটা আরও লম্বা হবে। একজন ব্যক্তিকে বারবার মনোনয়ন দেওয়া, তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে বা পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া এলাকায় একধরনের আধিপত্যবাদ তৈরি করে। এবার দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। অর্থাৎ প্রতি আসনে গড়ে ১১ জন। সবাই না হলেও প্রতি আসনে অন্তত ৫ জন আছেন, যারা সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন পেতে পারেন। কিন্তু বারবার একই ব্যক্তি বা পরিবার থেকে মনোনয়ন দিলে বাকিরা রাজনীতি করবেন কোন আশায়?

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় ২৩ জন নারী, ২০ জন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু আছেন, ৪ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রয়েছেন। এটা ভালো লক্ষণ। জনপ্রিয় খেলোয়াড়, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকারা রাজনীতিতে আসেন; এটা বিভিন্ন দেশের রীতি। বাংলাদেশেও অতীতে চিত্রনায়ক ফারুক, চিত্রনায়িকা কবরী এমপি হয়েছেন। এবারও চিত্রনায়ক ফেরদৌস মনোনয়ন পেয়েছেন। এবারের মনোনয়নের সবচেয়ে বড় চমক ও সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হলো সাকিব আল হাসানের মনোনয়ন। সাকিব আল হাসান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবং এখনো বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার আগেই সাকিব নেমে পড়লেন রাজনীতির মাঠে। এখন সাকিব খেলবেন, ব্যবসা করবেন নাকি রাজনীতি করবেন। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, সাকিব খেলা ও রাজনীতিকে ব্যবহার করে ব্যবসা করবেন। সাকিবের মনোনয়ন পাওয়া বা এমপি হওয়া নিয়ে আমার আপত্তি নেই। এর আগে মাশরাফীও এমপি হয়েছেন। কিন্তু খেলোয়াড়দের অন্তত অবসর নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অবসরের পর নির্বাচন করতে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। আর খেলোয়াড়রা অবসরের আগেই নির্বাচনে নেমে পড়েন। এটা হওয়া উচিত নয়।

যেমনটি বলছিলাম, ৭১ এমপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ দলে একটা শুদ্ধিকরণের বার্তা দিয়েছে। তবে এটা আরও ব্যাপক হতে পারত। আওয়ামী লীগকে ঠিক রাস্তায় রাখতে হলে মাঠপর্যায়ের নেতৃত্বের খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। আবার জনগণের কাছে যেতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালী করতে হবে। মাঠে যেহেতু বিরোধী দল নেই। আওয়ামী লীগকে তাই নিজেদের সঙ্গেই লড়াই করতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।