তালার পাখিমারা বিলে টিআরএম: ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় বাড়ছে অসন্তোষ

তালার পাখিমারা বিশে টিআরএম-এর জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রথম প্রকল্পের মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় প্রকল্প শুরু হলেও এখনো প্রদান করা হয়নি ক্ষতিপূরণের প্রায় ৭৫শতাংশ টাকা। আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় আটকে আছে কৃষকের স্বপ্ন। বিভিন্ন মহলে দৌড় ঝাপ করেও বরাদ্দকৃত টাকা মিলছে না। সর্বশেষ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দুই সহ¯্রাধিক জমির মালিক স্বাক্ষরিত আবেদনেও কোন কিনারা হয়নি।
জমি মালিকরা জানায়, কপোতাক্ষ নদের নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষে ২০১৫ সালে ২৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ১ম পর্যায়’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পে অর্ন্তভুক্ত টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য কৃষকদের এক হাজার ৫৬২ একর জমি গ্রহণ করা হয়। এজন্য ফসসের ক্ষতিপূরণে কৃষকদের জন্য প্রতি বছর একর প্রতি ৪২ হাজার ৬৯৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ বছরে উক্ত ক্ষতিপূরণের পরিমান ৪০ কোটি ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১২ টাকা।
জমি মালিকরা জানায়, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের মধ্যে ১০ কোটি ১২ লাখ ৭২ হাজার ৭৬৪ টাকা বিতরণ করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে ২০১৭-১৮ অর্থবছর হতে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্প চালু থাকলেও তাদেরকে আর কোন টাকা প্রদান করা হয়নি। চার বছরে অবিতরণকৃত টাকার পরিমান ২৯ কোটি ৮৮ লাখ ৭৪ হাজার ১৪৮।
জমি মালিকরা আরও জানায়, ক্ষতিপুরণের টাকা উত্তোলনের জন্য সরকারের শর্তানুযায়ী এসএ খতিয়ানের পর্চা, নামপত্তন, ক্রয়ের দলিল, পিঠ দলিল, হাল জরীপের পর্চা, খাজনা প্রদানের হাল দাখিলা, প্রাপ্য জমির হিসাব বিবরণী, নাগরিক সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিসহ ১২ রকমের কাগজ জেলা প্রশাসকের এল এ শাখায় জমা দেওয়া হয়। উল্লেখ্য এসকল শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে যাদের প্রথম বছরের টাকা ছাড় করা হয়েছে তাদের অনেকে অজানা কারণে ২য় বছর টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। অধিকাংশ কৃষকদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী ৪ বছর (২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১) তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি এবং তাদের জমিতে ফসলও ফলাতে পারেনি।
জমি মালিকারা জানায়, ২০১৫ সালে প্রকল্পের সংযোগ খাল নির্মাণের জন্য ১০ দশমিক ২৮ একর জমি স্থায়ী অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির মালিকরাও এখনো কোন ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি। সংযোগ খালের জন্য ৩৪টি পরিবার বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা বা পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এসময় একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় বাস্তুচ্যুত ৩৪টি পরিবারের গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়।
জমি মালিকা আরো জানায়, বাস্তবায়িত জোয়ারাধার (টিআরএম) বেসিনের মধ্যে অবস্থিত অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এ সকল জমির মালিককেরা জমিতে চাষাবাদ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু তারা কোন ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। এমনকি বেসিনের মধ্যে কি পরিমান জমি অধিগ্রহণের আওতায় আসেনি তারও পরিমাণ নির্ধারণ করেনি।
এলাকাবাসী জানায়, এই প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণকৃত জমির পাশে ২০১১-১২ অর্থবছরে বিলের চারিপাশে ১২ দশমিক ৮৭ কি.মি. পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ হয়। এই হিসেবে পেরিফেরিয়াল বাঁধের জমির মালিকদের ১০ বছরের ক্ষতিপূরণ পাওনা হলেও তাদেরকে মাত্র ২ বছরের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এই জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বাঁধ মেরামত করে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পে বিলে টিআরএম চালু করা হবে কি না সে ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে কি সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়নি। প্রকল্প শেষে এই বাঁধ অপসারণ করা হবে কিনা অথবা বাঁধের মাটি কে এবং কিভাবে অপসারণ করবে সে বিষয়টিও অনিশ্চিত।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প-২য় পর্যায়’ (জুলাই ২০২০ হতে জুন ২০২৪) এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চার বছর মেয়াদি দ্বিতীয় পর্যায়ের এই প্রকল্পে বরাদ্দ ৫৩১ কোটি ৭ লক্ষ টাকা।
ডিপিপি অনুযায়ী এ প্রকল্পে ১ম দুই বছরের জন্য একরে প্রতিবছর ৫৩ হাজার ৭১৩ টাকা হিসেবে মোট ১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। ২য় পর্যায় প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে কিন্তু সে অর্থ কৃষকদের দেয়া হচ্ছে না এবং পেরিফেরিয়াল বাঁধ মেরামত করে টিআরএম চালু করাও হচ্ছে না। এতে একদিকে জমি মালিকরা সীমাহীন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে নদী নাব্যতা হারিয়ে পুনরায় জলাবদ্ধতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ভারতীয় বন্যার পানি প্রবেশের পর হতে কপোতাক্ষ অববাহিকার অধিকাংশ এলাকা র্দীর্ঘদিন যাবত স্থায়ীভাবে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত ছিল। জলাবদ্ধতাজনিত বন্যায় বছরের ৬ থেকে ৮ মাস ফসলের জমিসহ জনপদ প্লাবিত হতো। প্রায় ১০-১৫ লক্ষ মানুষ এই জলাবদ্ধতাজনিত বন্যায় আক্রান্ত হতো। প্লাবিত হতো ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাট বাজার, স্কুল-কলেজ। শত শত কোটি টাকার ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, গাছপালার ক্ষতি হতো। মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তো কাচা-পাকা ঘরবাড়ী ও অবকাঠামো। বিপর্যয়ের মুখে পড়ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতো বছরের প্রায় ৭-৮ মাস। মানুষ আশ্রয় নিত উচু বাঁধ বা রাস্তার উপর, অনেকেই রাত কাটাতো খোলা আকাশের নীচে। সমগ্র এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় স্থাপনায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হতো। জলাবদ্ধতাজনিত বন্যার কারণে বহু মানুষ স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে অভিবাসিত হতে বাধ্য হয়।
এমন পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর ২০১০ সালের ২৩ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করে শ্যামনগরের মহাসীন ডিগ্রী কলেজ মাঠের এক জনসভায় কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা নিরসনের ঘোষণা দেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণার পর অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
এলাকাবাসীরা জানায়, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)-এর আওতায় ২০১৫ সালে পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে সে বছরেই কপোতাক্ষ অববাহিকার সমগ্র এলাকা সম্পূর্ণভাবে জলাবদ্ধমুক্ত হয়। এ প্রকল্পের ফলে এ জনপদের প্রায় ১৫ লক্ষ অধিবাসী প্রত্যক্ষভাবে এবং প্রায় ৪০ লক্ষ অধিবাসী পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে। এ এলাকার প্রধান উৎপাদন সেক্টর কৃষিক্ষেত্রে ব্যপক উৎপাদন বেড়েছে। হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, যোগাযোগসহ এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রাণ ফিরে এসেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৮ বছর এ এলাকায় আর জলাবদ্ধা দেখা দেয়নি। পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানসহ সকল সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। উপরন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সামগ্রিকভাবে শত শত কোটি টাকার উপকার হয়েছে। এলাকার নদীসমুহ ফিরে পেয়েছে জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলা, ভূমি গঠন প্রক্রিয়ার পুনরুর্জ্জীবন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় টিআরএম অনন্য অবদান রেখেছে।
এদিকে গত ২১ জুলাই ২০২৩ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান দুই দিনের সফরে সাতক্ষীরায় এলে কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সম্পর্কিত উল্লেখিত সমস্যাগুলো তার নজরে আনা হয়। পরবর্তীতে পাখিমারা বিলে টিআরএমে ক্ষতিগ্রস্ত ২০৪৭জন জমি মালিক স্বাক্ষরিত একটি একটি স্মারকলিপি মাননীয় সচিব বরাবর প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে প্রকল্পের ১ম পর্যায় প্রকল্পের বকেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা এবং চলমান ২য় পর্যায় প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের টাকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহজ উপায়ে প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়। কিন্তু অদ্যাবধি উক্ত সমস্যা সমাধানে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফিয়া শারমিন জানান, ভুক্তভোগীরা যদি পুনরায় আবেদন করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।

Check Also

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।