ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট: : শারীরিক উচ্চতা মাত্র সাড়ে তিন ফুট। পা নেই বললেই চলে। হাতও ছোট। শারীরিক বৃদ্ধি কোমর পর্যন্ত। কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেননা। এজন্য শুয়ে ও বসে সময় কাটাতে হয় তাকে। অথচ, এত রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারিনি সাতক্ষীরার ৪২ ইঞ্চি উচ্চতার সাজিয়া সুলতানাকে। একদিকে মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম অপরদিকে উপহারের স্মার্টফোনে অনলাইনে ক্লাস করে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।
সাজিয়া সুলতানার বাসা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ আলিপুরে। বর্তমানে সেখানেই নানা শামসুল আলমের বাসাতে থাকেন তিনি।
জানা যায়, ২০০১ সালে জন্মগত ভাবে সাজিয়া সুলতানা প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় তার মা শরিফা খাতুনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে অনত্র চলে যান পিতা আব্দুস সবুর। সেই থেকে নানার বাসা থেকেই পড়াশুনা করতে থাকেন সাজিয়া। আর ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় প্রচুর মেধাবী হওয়ায় সাজিয়ার লেখাপড়ার কথা ভেবে অন্যত্র বিয়ে করেননি তার মা শরিফা খাতুন। দরিদ্রতার কাছে হার মেনে সাজিয়া সুলতানাকে সু-চিকিৎসা দিতে পারেননি। তবে অভাব-অনটনের সাথে যুদ্ধ করে সাজিয়ার লেখাপড়ায় সংগ্রাম চালান শরিফা খাতুন।
পিএসসি পরিক্ষায় গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পর পার্শ্ববর্তী আলিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন সাজিয়া। এসময় সাজিয়াকে নিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেতেন তার মা শরিফা খাতুন। আর এভাবে বছরের পর বছর শরিফা খাতুন নিজে সাইকেল চালিয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতেন। মায়ের কঠোর পরিশ্রম সেবার বৃথা যায়নি। জিএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পাশাপাশি ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগেও গোল্ডেন এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হন সাজিয়া সুলতানা।
একপর্যায়ে এসএসসি পাশ করার পরে কলেজে ভর্তির টাকা যোগাড়ের বিষয়টি মাথায় আসতে উড়ে যায় পরিবারটির সব উচ্ছ্বাস! উল্লাসের বদলে ভর করে দুশ্চিন্তা, অর্থাভাবে শেষমেষ ভর্তি না হওয়ার শঙ্কা আর বি.সি.এস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ভাঙ্গার দুর্ভাবনায় দিন গুনতে হয় সাজিয়া সুলতানাকে। পরবর্তীতে বিষয়টি তৎকালিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যানের নজরে আসলে তিনি সাজিয়ার ভর্তির জন্য আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে স্কুল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন, যাতায়াতের জন্য হুইলচেয়ারসহ বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী দেন। এছাড়া জেলা পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তিরা সাজিয়ার পাশে দাঁড়ান।
তবে পায়ের অপারেশনজনিত কারণে ২০২২ সালের এইচএসসি পরিক্ষায় অংশ নিতে পারেননি সাজিয়া। এরপরেও দমে যাননি তিনি। অসুস্থতার মাঝেও সারাক্ষণ মোবাইলে ক্লাস করতেন। আর দীর্ঘ তিনবছর স্মার্টফোনে ক্লাস করে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরিক্ষায় অংশ নেন। আর এই পরীক্ষায় এ+ পেয়ে পাশ করেছেন সাজিয়া। বর্তমানে মেডিকেলে চান্সের জন্য ওই স্মার্টফোন দ্বারা উদ্ভাসে কোচিং করছেন তিনি।
সরেজমিনে সাজিয়ার বাসাতে যেয়ে দেখা যায়, নিজস্ব কোন ঘর নেই তাদের। নানার বাসাতে বসবাস করেন সাজিয়া ও তার মা শরিফা খাতুন। আর বসত বাড়ির একটা রুমের ভিতরে পাঠ্যবই বই সাজানো। পাশে রয়েছে হুইল চেয়ার। আর ওই ঘরে দিনের ২৪টা ঘন্টা পার করতে হয় সাজিয়ার। বর্তমানে কারও সাহায্য ব্যতিত সেভাবে চলাফেরা করতে পারেন না।
সাজিয়া সুলতানা জানান, ছোটবেলা থেকে সেভাবে চলাফেরা করতে পারেননা তিনি। অল্প হাঁটাচলা করলে সমস্যা হয়। একপর্যায়ে বয়সের সাথে সাথে বর্তমানে কারও সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেননা তিনি। এজন্য রাতদিন ২৪ ঘন্টা একপ্রকার ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়।
তার ভাষায়, প্রকৃতির সাজা ভোগ করতে হচ্ছে তারসহ তার মা শরিফা খাতুনের। প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মেছি বলে মায়ের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন বাবা। সেই থেকে কখনও পিতৃত্বের ভালোবাসা পায়নি। জানিওনা বাবার ভালোবাসা কেমন হয়! এসব মনোকষ্টে নিজের শিক্ষাজীবন শুরু।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমার ভবির্ষতের কথা ভেবে আমার মা বিয়ে করেননি। বরং বছরের পর বছর তিনি নিজে সাইকেল চালিয়ে আমাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। আর আমি নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এজন্য পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরিক্ষায় গোল্ডেন এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এসময় উল্লাসের বদলে ভর করে দুশ্চিন্তা, অর্থাভাবে শেষমেষ ভর্তি না হওয়ার শঙ্কা আর বি.সি.এস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন ভাঙ্গার দুর্ভাবনায় দিন গুনতে হয়েছিল।
কারন হিসেবে সাজিয়া সুলতানা বলেন, শ্রেণীভেদে পড়াশোনায় খরচ বেশি। আর আমিতো বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। এজন্য এসএসসি পাশ করার পর আমার মায়ের পক্ষে আমার পড়ালেখার খরচ বহন করা সম্ভব ছিলনা। তার উপর আমার শারিরীক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সমস্যার কারনে সাইকেলে বসতে পারতাম না। এজন্য হুইল চেয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে অর্থ-অভাবে সেটাও কিনতে পারিনি। একদিকে ভর্তিতে অনিশ্চয়তা অপরদিকে যাতায়াতের জন্য হুইল চেয়ার কেনারও সক্ষমতা ছিল না। এজন্য সবকিছু মিলিয়ে আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার শঙ্কা তৈরী হয়। আর ওইসময় স্থানীয় মফিজুল রহমান জুয়েলের মাধ্যমে বিষয়টি তৎকালিন উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবুর নজরে আসলে তিনি আমার লেখাপড়ার জন্য খরচ বহন করেন। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন, যাতায়াতের জন্য হুইলচেয়ারসহ আমার চিকিৎসাসেবায় আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন। পরে জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানসহ অনেকে তার পড়াশোনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন। এজন্য নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছেন বলে জানান তিনি।
বিসিএস ক্যাডার হতে চান জানিয়ে সাজিয়া আফরিন বলেন, স্বপ্ন সবার-ই থাকে। পূরণ করার মালিক আল্লাহ্। এইচএসসি পাশ করার পর বর্তমানে মেডিকেলে চান্সের জন্য কোচিং করছি। সেটাও স্মার্টফোনের মাধ্যমে। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ্ চাইলে ভালো কিছু হবে। এজন্য সকলের দোয়াও চান তিনি।
এব্যাপারে সাজিয়ার মা শরিফা খাতুন বলেন, আমার একার পক্ষে সাজিয়ার লেখাপড়া করানো সম্ভব ছিল না। সবাই কমবেশি সহযোগিতা করেছেন। একারনে, সাজিয়া তার শিক্ষারজীবনে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। আর মা হিসেবে আমি গর্বিত।