ফারাহ মাসুম ॥
সর্বাত্মক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা সত্ত্বেও একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে অগ্রসর হচ্ছে শাসকদল। এর মধ্যে সরকারের সামনে আতঙ্কের বিষয় হলো বিরোধীদলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন। বিরোধীদলগুলো এর মধ্যে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য ডান-বাম-মধ্যমপন্থী মিলিয়ে ব্যাপকভিত্তিক ঐক্য তৈরি করেছে। তারা নির্বাচনের ইস্যুর পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনকে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এ লক্ষ্যে একটি প্রবল ধরনের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিরোধীপক্ষ। সরকারি দলের সূত্র বলছে, বিরোধীপক্ষের এ ধরনের আন্দোলন তৈরি হলে কী পদক্ষেপ নেয়া যাবে, সেই বিষয়ও সামনে রাখা হয়েছে। সরকারের আশঙ্কা অনুসারে বড় ধরনের বাণিজ্যসহ অন্য নিষেধাজ্ঞা এলে ও দেশের ভেতরে প্রবল আন্দোলন সৃষ্টি রোধ করা না গেলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি ও নতুন কোনো সমঝোতার ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এসব ভাবনা বাস্তবে রূপ দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে একতরফা নির্বাচনের আয়োজনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হলে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি প্রতিবেশী দেশ ভারত সব ধরনের সহায়তা নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে বলে শাসকদলের একটি সূত্র দাবি করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী লবি বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঠেকানো এবং বৈশ্বিকভাবে উদার গণতন্ত্রবিরোধী বলয়ে চলে যাওয়া ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেছে। বলা হয়েছে, সংলাপ ও সমঝোতা ব্যর্থ প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য সম্পদ বিনিয়োগ করার পরে, এখন সময় এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন করার এবং এখানকার কর্তৃত্ববাদী শাসন মোকাবিলা করার জন্য একটি ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করার। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, ইসরাইলে হামাসের হামলা ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য চীনের হুমকির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন সংস্থানগুলোকে সীমিত করে ফেলার সাথে উল্লেখযোগ্য বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ে ঢাকায় প্রবল কর্তৃত্ববাদিতার উন্নয়ন ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত জন ড্যানিলোভিজ বলেছেন, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্ধারণে সাহায্য করার জন্য পরামর্শের জন্য রাষ্ট্রদূত হাসকে প্রত্যাহার করা অর্থপূর্ণ হবে। মার্কিন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হাস ও তার দল যথেষ্ট চাপের মধ্যে গত এক বছরে অসাধারণ কাজ করেছে এবং উচ্চাভিলাষী নীতি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার দায় তাদের দেয়া উচিত নয়। বিকল্পগুলো পর্যালোচনা করার সময় মার্কিন কর্মকর্তাদের কংগ্রেসের সাথে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে উন্নয়নগুলোকে প্রভাবিত করার জন্য উপলব্ধ সব বিকল্প দেখা উচিত, যার মধ্যে স্পষ্ট করা দরকার যে স্বৈরাচারী পথ চালিয়ে যাওয়ার প্রকৃত বড় মূল্য রয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন উন্নয়ন সহায়তা সংস্থানগুলো পুনর্নির্দেশিত করা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় এবং বিশেষায়িত জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয় এ উভয় ধরনের সহায়তা থাকবে। বাংলাদেশের সামরিক, আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সমর্থন করে মার্কিন নিরাপত্তা সহায়তার প্রচেষ্টাগুলোকেও স্থগিত রাখা উচিত যতক্ষণ না এ সংস্থাগুলো ভিন্নমতকে দমন করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে চলেছে। বার্ষিক অংশীদারি সংলাপ এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক আলোচনার মতো উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত।
জন মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে তার ভোটের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিশ্চিত করা যে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে খারাপ আচরণের প্রতিদান দিচ্ছে না। অবশেষে বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার হুমকির মুখে পড়তে থাকায়, আরএমজি আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে কিনা, তা নির্ধারণ করতে প্রশাসন ও কংগ্রেসের বাণিজ্য নীতির দিকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা উচিত। একই সময়ে ওয়াশিংটনকে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী ও সুশীল সমাজের অভিনেতাদের সমর্থন করার উপায়গুলো সন্ধান করা উচিত, যারা শাসনের বর্ধিত চাপের মুখোমুখি হন।
জন ড্যানিলোভিজ যুক্তি দেখান যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশকে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহায়তা পর্যালোচনা করা উচিত এ কারণে যে, দেশটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে একতরফা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের স্বৈরাচারকে সমর্থন করা এড়াতে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রোগ্রামগুলো সাবধানতার সাথে পর্যালোচনা করতে হবে। যারা বাংলাদেশ ও এর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই এ ধরনের প্রচারণায় প্রভাবিত হতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত দেশের ভোটাররাই নির্ধারণ করবে নির্বাচনের কোনো বৈধতা আছে কিনা।
জন মনে করেন, বর্তমান পরিবেশে এটা ভাবা বাস্তবসম্মত নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করবে এবং ভারত, চীন ও রাশিয়ার সাথে মিলিত হবে। তারপর যৌক্তিক বিকল্প হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তার প্রচেষ্টাকে পুনর্নির্মাণ করা এবং অন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে তার নেতৃত্ব অনুসরণ করতে রাজি করা। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দিকে যখন পেন্ডুলাম ফিরে আসে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দেশের সাফল্যে পুনর্বিনিয়োগ করার কথা বিবেচনা করা। ততক্ষণ পর্যন্ত খারাপের পরে ভালো অর্থ নিক্ষেপ করা বন্ধ করার এবং এমন বার্তা দেয়ার সময় এসেছে যে, প্রয়োজনে একক ব্যস্ততাই কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন করবে।
এদিকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রাক্কালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহিংস স্বৈরাচারী দমন-পীড়নের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে কূটনৈতিক অংশীদারদের উচিত এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র এশিয়া গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেছেন, ‘সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের সাথে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার দাবি করছে, যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ একই সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগার ভরাচ্ছে। এ অবস্থায় কূটনৈতিক অংশীদারদের স্পষ্ট করা উচিত যে, সরকারের স্বৈরাচারী দমন-পীড়ন ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপন্ন করবে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সাধারণ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলকে দমন করতে এবং প্রতিযোগিতা দূর করার সুস্পষ্ট প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বিরোধীদের গণগ্রেফতার চালাচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মতে, তাদের ৫০ লাখ সদস্যের প্রায় অর্ধেকই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন হয়।
আটকের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের কারাগারে ধারণক্ষমতা ৪২,০০০ থাকলেও আমরা ৯০,০০০ বন্দী রাখতে পারি। তাই এখনই কারাগারের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার নেই।’
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কয়েকজনকে হেফাজতে মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন মহিলা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছিলেন যে, তার ভাইকে ‘বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং আমি লক্ষ করেছি যে তার বাম হাতের একটি আঙুল ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।’ একজন বিএনপি কর্মী বলেছেন যে, তার হৃদরোগ থাকা ভাইকে ৩০ অক্টোবর পুলিশ তুলে নিয়ে ১০ দিনের জন্য অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে এবং স্বাস্থ্যের উদ্বেগের বিষয়ে তার আবেদন সত্ত্বেও তাকে হেফাজতে মারধর করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বিদেশি সরকারগুলোকে জোর দেওয়া উচিত যে, কর্তৃপক্ষ যেন মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য তাদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বজায় রাখে। বাংলাদেশ ইইউ-এর ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ বাণিজ্য কর্মসূচির প্রধান সুবিধাভোগী এবং বাংলাদেশ সরকার সাধারণীকৃত স্কিম অফ প্রেফারেন্স ব্যবস্থার জন্য আবেদন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে, যা গার্মেন্টসসহ মূল রপ্তানিতে কম বাণিজ্য শুল্কের সুবিধা প্রসারিত করবে। সরকারের অপব্যবহারগুলো যেকোনো প্রোগ্রামের জন্য তার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কারণ উভয়ই নির্দিষ্ট মানব ও শ্রম অধিকারের মানদণ্ডের ওপর শর্তযুক্ত। সাম্প্রতিক সফরে ইইউ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ইউরোপীয় পার্লামেন্টও সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, একটি অবাধ নির্বাচন অসম্ভব, যখন সরকার স্বাধীন মতপ্রকাশ বন্ধ করে দেয় এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিরোধী সমালোচক এবং কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, হয়রানি এবং ভয় দেখানোর মাধ্যমে অক্ষম করে। সহিংসতা উসকে দেওয়া এবং তার সমালোচকদের কারাগারে পাঠানোর পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে নির্বিচারে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার বন্ধ করার আহ্বান জানানো উচিত এবং স্পষ্ট করা উচিত যে, নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং হত্যা সহ্য করা হবে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বেশ কয়েকটি বিদেশি সরকার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বার বার আহ্বান জানিয়েছে এবং কর্তৃপক্ষকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য তাদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার জন্য জোর দেওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেছে। ৩১ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, ‘জনগণকে তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ থেকে বাধা দেওয়া এবং ইন্টারনেট অ্যাক্সেসসহ যেসব পদক্ষেপ গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করে তা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞার কথাও বিবেচনা করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বরের শুরুতে আওয়ামী লীগ নেতারা বার বার হাসকে মারধর বা হত্যার হুমকি দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুমকির নিন্দা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের হুমকি না দেওয়ার জন্য দলের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এ সময় একটি আদালত আওয়ামী লীগ সদস্যদের একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে একটি মামলা খারিজ করে দেন, যারা রাষ্ট্রদূতকে হুমকি দিয়েছিল এবং একই দিনে মিডিয়া রিপোর্টে অভিযোগ করা হয় যে, আরেক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, হাসকে ‘জবাই করা উচিত’।
রিপোর্টে বলা হয়, ১৪ নভেম্বর জাতিসংঘের তিনজন বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন যে, তারা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার তীব্র বৃদ্ধি, বিরোধীদলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্বিচারে আটক করা, কর্তৃপক্ষের অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ ও বিক্ষোভকে ব্যাহত করার জন্য ইন্টারনেট বন্ধের কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারা একই সাথে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, ভয় দেখানো এবং বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার হুমকিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গণগ্রেপ্তার ও হেফাজতে অপব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিরোধীদলের নেতাকর্মী, সরকারের সমালোচকও রয়েছে। বিএনপি ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে গ্রেপ্তার হওয়া বিরোধীদলের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মিডিয়া সমন্বয়কারী জহির উদ্দিন স্বপন, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আর ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সেক্রেটারি আমিনুল হক।
মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টে বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রে বিরোধীদের ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়। অভিযুক্তদের কেউ কেউ হয় মৃত, বিদেশে অথবা তাদের কথিত অপরাধের সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিল, মামলায় তাদেরও আসামি করতে দেখা গেছে। ব্যানার নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের একটি প্রতিবেদনে নাসির রহমান নামে এক বিএনপি কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি তিন বছর আগে মারা গেলেও ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে পুলিশের ওপর হামলা এবং মলোটভ ককটেল নিক্ষেপের জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নাসির রহমানের বিধবা স্ত্রী রিনা আক্তার ব্যানার নিউজকে উদ্ধৃত করে বলেন, “আমি মামলার বাদীকে শুধু বলব যে, সম্ভব হলে আমার স্বামীকে তার কবর থেকে গ্রেপ্তার করুন।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একজন বিএনপি কর্মীর সাথে কথা বলেছে, যাকে ২৮ অক্টোবর সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত একটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যখন তিনি দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন দেশে ছিলাম না, তখন বাংলাদেশে নাশকতা বা উপদ্রব সৃষ্টির অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে কীভাবে অভিযোগ হতে পারে?’ তিনি বলেছেন নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা জোরপূর্বক গুমের ভয়ে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধীদলের অনেক সদস্য আত্মগোপনে চলে গেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের আগামী দিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাতে অর্থনীতি একটি বড় নির্ণায়ক হতে পারে। বাংলাদেশ এখন তীব্র বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে ভুগছে। দেশের নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। অর্থের অভাবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে বেতন-ভাতা দিতে সমস্যা শুরু হয়েছে। চীনা বাজেট সহায়তার অর্থ থেকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচের সংকুলান করা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। এ অবস্থায় উন্নয়ন সহায়তার ৮ বিলিয়ন ডলার আলোচনায় চলে এসেছে। আইএমএফের উল্লেখ করা ৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তার একটি প্যাকেজের বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্লাইমেট অ্যাডেপ্টেসানের জন্যে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইইউ, এআইইবি, জাইকা, এএফডি, ইআইবিসহ সকল প্রধান উন্নয়ন সহায়তাকারী সংস্থা মিলিয়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের একটা সমন্বিত সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে। যে কর্মসূচির কিছু অংশ এর মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকিটা প্রজেক্ট বেজড সামনে ঘোষণা করা হতে পারে।
বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য এ কর্মসূচি স্থগিত করার কোনো পদক্ষেপ নিলে সরকার বড় রকমের চাপে পড়বে। এমনকি সরকারের জন্য প্রশাসনকে এগিয়ে নেয়াও কঠিন হতে পারে। এর পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সরকারের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। শেষ পর্যন্ত জন ড্যানিলোভিজের সুপারিশ অনুসারে এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র নেবে কিনা, সেটি একটি বড় নির্ণায়ক হতে পারে। যদিও সরকারের উগ্র সমর্থকদের কেউ কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তাদের থামাতে পারবে না। ভেনেজুয়েলার মতো যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা বলয়ে ঢুকে গিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দেবে। প্রয়োজনে অর্থনীতি এক-তৃতীয়াংশ সংকুচিত হলেও ক্ষমতার ভিত্তিগুলোর সমর্থন থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না। দরকার হলে সিরিয়ার ‘আসাদ মডেল’ অনুসরণ করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া যাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত এক বছরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচারের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট কূটনৈতিক শক্তি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে গত মে মাসে ঘোষিত ভিসানীতিটি সর্বাধিক মনোযোগ পেয়েছে। মার্কিন কূটনৈতিক উদ্যোগে বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের অন্য উপাদানগুলোর সাথে জড়িত থাকার একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বার্ষিক কাঠামোগত অংশীদারিত্বের সংলাপ এবং উচ্চস্তরের সামরিক ও অর্থনৈতিক ফোরামের সময় ওয়াশিংটন এবং ঢাকা উভয় ক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। এ ব্যস্ততার সময় মার্কিন কর্মকর্তারা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বহুমুখী ক্ষেত্র এবং যৌথ প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। এ পুরো সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর দিয়েছিল যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও সম্প্রসারণ এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণে দেশটির জন্য আরও বিশিষ্ট স্থানের পরিস্থিতি তৈরি করতে সাহায্য করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মে মাসের নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে সীমিতসংখ্যক ভিসা বাতিল করলেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ধাক্কা দেওয়ার কৌশলটি লাঠির চেয়ে গাজরই জড়িত (স্টিক এন্ড ক্যারোট) বেশি।
পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন অনুসারে, এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটা এখন স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে প্ররোচিত করার মার্কিন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং অক্টোবরের শেষের দিকে ঢাকার রাস্তায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদাররা মূলত সাইডলাইনে দাঁড়ানো বেছে নেয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে, হাজার হাজার বিরোধী নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন দল আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর বলে বার্তা দিচ্ছে। এ অবস্থায় কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া কর্তৃত্ববাদিতা থেকে কোনো কিছু সরকারকে নিবৃত করতে পারবে না। এটি দেশের উন্নয়ন অংশীদারদের পক্ষ থেকে যেমন আসতে হবে। তেমনিভাবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেও দুর্বার আন্দোলনের জন্য কোয়ালিশন গড়ে তুলতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অন্য ডান-বাম-মধ্যমপন্থী দলগুলো এ ব্যাপারে জোরালো ঐক্য গড়ে তুলেছে বলে জানা গেছে।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …