রাজনীতিবিদ হঠাৎ উদিত হন না। দীর্ঘ পথচলা আর সংগ্রামে গড়ে উঠে একজন রাজনীতিবিদের ক্যারিয়ার। এমনকি সেনা ছাউনি থেকে যারা রাজনীতিতে আসেন তারাও ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন নিজের মূর্তি। কেউ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পান, কেউবা হন পরিত্যাজ্য। জিএম কাদের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন মন্ত্রী। এর চেয়েও তার বড় পরিচয় ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভাইয়ের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখান জিএম কাদের। এর আগ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির ইনার সার্কেলে তাকে মনে করা হতো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। কিন্তু ওই নির্বাচন পাশার দান উল্টে দেয়।
আনুগত্য, আদর্শ, রাজনীতি, স্বার্থ কিংবা অন্য কিছু বদলে দেয় রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরকে। রওশন হঠাৎই ভিড়ে যান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। অন্যদিকে জিএম কাদের থেকে যান অনড়। এর জন্য তাকে মূল্যও চুকাতে হয়।
তবে এরপর থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন জিএম কাদের। জাতীয় পার্টির একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন তিনি। গোলকিপার আর স্ট্রাইকার নিয়ে তার দেয়া একটি বক্তব্য তো ব্যাপক প্রচার পায়। দলের তৃণমূলে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ঘড়ির কাঁটা থেমে থাকে না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির বাটন চলে আসে জিএম কাদেরের হাতে। তবে বিষয়টি সহজ ছিল না। এ নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়েছে অনেক। এমনকি আদালতেও যেতে হয়েছে তাকে। রওশন এরশাদ এবং তার সমর্থকরা শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জ তৈরি করেন। যদিও জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বেশির ভাগ সময়ই জিএম কাদেরকে সমর্থন জানিয়ে আসছেন।
সাম্প্রতিক অতীতে জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে আলোচনায় রাখতে সক্ষমতার পরিচয় দেন। যদিও প্রকৃত ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির অবস্থান কোথায় তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আর সংশয় রয়েছে। স্থানীয় কিংবা উপনির্বাচনগুলোতে রংপুর শহর ছাড়া কোথাও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভালো করতে দেখা যায়নি। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় ইসলামী আন্দোলন থেকেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কম ভোট পেয়েছেন। তবুও সংসদের বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি গুরুত্ব পেয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে জিএম কাদেরের বহু বৈঠক হয়েছে। বিশেষত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে তার বৈঠকের খবর বারবার মিডিয়ায় এসেছে।
গেল বছরগুলোতে জিএম কাদের ধারাবাহিকভাবে সরকারের সমালোচনা করে এসেছেন। সরকারবিরোধী আন্দোলনে যোগ না দিলেও বিরোধী নেতার এক ধরনের ভাবমূর্তি তৈরি করেন তিনি। তবে গত আগস্টে ভারত সফর করে আসার পর বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকতে দেখা যায় তাকে। পরে অবশ্য আবার সরব হন। সরকারের কঠোর সমালোচনায় মুখর হন। মধ্য নভেম্বরে জাতীয় পার্টির নির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে বেশির ভাগ সদস্য মত দেন। তবে কাহিনী সেখানেই শেষ হয়নি। এরইমধ্যে তৎপর হয়ে ওঠেন জাতীয় পার্টির এমপিরা। তারা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। রওশন এরশাদকে ঘিরে তার অনুসারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে আলাদাভাবে বঙ্গভবনে যান জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ। তবে তখনো নির্বাচনের পরিবেশ নেই উল্লেখ করে জিএম কাদের এক সভায় বলেছিলেন, নির্বাচনে গেলে স্যাংশন আসারও সম্ভাবনা রয়েছে।
পরিস্থিতি পাল্টে যায় দ্রুতই। ২২শে নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। সেদিন জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতা কোথায় ছিলেন তা নিয়ে গুঞ্জন তৈরি হয়। নির্বাচনী তৎপরতা চলতে থাকে জাতীয় পার্টিতে। মনোনয়নপত্র বিক্রি, দাখিলও সম্পন্ন হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জিএম কাদের নীরব। গত দুই সপ্তায় মিডিয়াতে একটি কথাও বলেননি তিনি। এটি মনে হয় গণতান্ত্রিক দুনিয়াতেই বিস্ময়কর ঘটনা। যে দল নির্বাচনে অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সে দলের প্রধান মুক্ত অথচ একটি কথাও বলছেন না। নানা সূত্র বলছে, নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং না নেয়া দুই ব্যাপারেই জিএম কাদেরের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথই বেছে নেন। এরইমধ্যে অনেককে হতবাক করে রওশন এরশাদ এবং তার অনুসারীরা নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েন। অন্য একটি পক্ষ এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা রাখে।
তবে সংকটের সুরাহা হয়নি এতেও। জাতীয় পার্টির একটি সূত্র বলছে, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কাজী ফিরোজ রশীদসহ জাপা’র একটি অংশ জিএম কাদেরকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অংশের অনেকে এখন সমঝোতা ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তারা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনে গিয়ে সবই হারাতে হতে পারে। তারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছেন। যে কারণে সরকারের সঙ্গে আলোচনা জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন মহলের মত হলো, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবেই দাঁড়াক। দশ বছর তারা সরকারের আনুকূল্যে বিরোধী দলে। এই সময়ে তাদের মধ্যে সক্ষমতা বাড়বে এটাইতো স্বাভাবিক ছিল। মাঠের বিরোধী দল যেখানে অনুপস্থিত সেখানে জাতীয় পার্টির এতো ভয় কেন? প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে নির্বাচন আবারো হাস্যকর হবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাছাড়া সমঝোতার নির্বাচন হলে আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট আরও বাড়তে পারে। এরমধ্যেই বুধবার বৈঠক হয়েছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে। জাতীয় পার্টি সর্বনিম্ন ৩৫টি আসন দাবি করেছে। শাসক দল এখনো এ ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। জাতীয় পার্টি ঢাকার দুটি আসন এবং জিএম কাদেরের রংপুরের আসনের ব্যাপারে জোর দিয়েছে। বিশেষত ফিরোজ রশীদের ঢাকা-৬ আসনটির কথা বলা হয়েছে। যেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। এ ছাড়া, জাতীয় পার্টি আরও কিছু পদ চেয়েছে। শাসক দলের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের আসনও।
জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলেও পুরো বিষয়টিতে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। রয়েছে বিশ্বাস-অবিশ্বাস। বিশেষত ভোটের পরীক্ষা নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে রয়েছে নানা শঙ্কা-আশঙ্কা? জিএম কাদেরের নির্বাচিত হয়ে আসাটা কি নিশ্চিত সে প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে। তার জন্য কি অন্য কিছু অপেক্ষা করছে? নিয়তি এবং রাজনীতি মাঝে-মধ্যে কী খেলাটাই না খেলে থাকে! রাজনীতি যেমন দীর্ঘদিন খেলছে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে!