উপকূলীয় অঞ্চল (শ্যামনগর): সুন্দরবন লাগোয়া বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুর গ্রামেই বসবাস মুনজিলার। সুন্দরবনের উপর দিয়ে ভোরের সূর্য উঁকি মারে মঞ্জিলার জানালায়। জল আর জঙ্গল জীবনের অভাব অনটনের মধ্যে জীবন কাটছে মুনজিলার পরিবার। ১৯৮৮সালে মুনজিলার বিয়ে হয় বুড়িগোয়ালিনী এলাকায় এক নিম্ন পরিবারের ছেলে আবু হাসান ঢালির সাথে। ভালো চলছিল তাদের সংসার। দুই মেয়ে আর দুই ছেলে জন্ম নেওয়ার পরে স্বামী আবু হাসান ঢালী সুন্দরবনে মধু ভাঙতে যায়। নিয়মনুযায়ী সরকারিভাবে বৈধ পাস নিয়ে সুন্দরবনে দু’দিন যেতে না যেতেই কপাল টললো মুনজিলার। বিধির লেখা কে পারে খন্ডাতে? অন্য দিনের মতো (৭ মে ২০০৬) সকালে উঠলো মধু সংগ্রহ করতে। সুন্দরবনের হরিখালী খাল এলাকায় হঠাৎ সুন্দরবনের হিংস্র বাঘ ঝাপিয়ে পড়লো স্বামী হাসান ঢালীর উপর।
সাথে থাকা সহযোগীরা বাঘের মুখ থেকে ছাড়িয়ে নিলো হাসানকে। ততক্ষণে উড়ে গেল হাসানের প্রাণপাখি। রাতে খবর ছড়িয়ে পড়লো হাসান ঢালি বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছে। ঐদিন ভোর রাতে ঘাটে নিয়ে আসলো হাসানের মরদেহ। গ্রামবাসী ছুটে আসলো হাসানের মরদেহ দেখতে। আত্মীয় স্বজনরাই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলো। দুপুরের মধ্যে লাশ দাফন করা হলো কবর স্থানে।
তারপর হতে শুরু হলো বাঘ বিধবা মুনজিলার চার সন্তান নিয়ে জীবন সংগ্রামের পথচলা। স্বামী অথবা বাড়ির বয়স্ক বনজীবী পুরুষরা সুন্দরবনে মধু ভাঙতে গেলে বাড়িতে স্ত্রী ও মায়েদের যে যে নিয়ম মেনে চলতে হয় তা হলো-সুন্দরবনে মধু ভাঙতে যাওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী খুব ভোরে উঠেই রান্না ঘরের চুলায় কাদামাটির লেপন দিতে হবে। উঠান ঘরবাড়ি লেপতে হবে, ঝাড়ু দিতে হবে। স্বামীর সুন্দরবনের পবিত্রতা রক্ষা করতে হয় বাড়িতে থেকে সেই সকল নারীর। সুন্দরবনের মধু ভাঙতে যাবে বাড়িতে থাকা স্ত্রীকে মাথার চুলে তেল দেওয়া ও চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানো যাবে না। এমনকি ঝাল আগুন দিয়ে পোড়ানো যাবে না, অন্য কোন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া বিবাদ করা যাবে না।
এই রীতিটি যতদিন পর্যন্ত এক স্ত্রীর স্বামী সুন্দরবন থেকে মধু কেটে বাড়িতে ফিরে না আসবে, ততদিন কঠিন ব্রত পালন করতে হবে একজন স্ত্রীকে।
আলাপচারিতায় একজন বনজীবী আমজাদ হোসেন বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে সুন্দরবনের মধু ভাঙতে যাওয়ার আগে মা বনবিবির নামে একটি ভালো মোরগ কিংবা মুরগি সুন্দরবনে মানত করে ছেড়ে দিত আর বলতো মা আমার স্বামী কিংবা আমার ছেলে সুন্দরবনের মধু ভাঙতে যাচ্ছে তুমি একটু দেখে রেখো।
এই রেওয়াজ মেনে চলতে সুন্দরবনে স্বামী মধু সংগ্রহ করতে গেলে বাড়িতে চুলা লেপতে হয় প্রতিদিন সকালে স্ত্রীকে, তাই প্রতিদিনের মতো সকালে হাসানের স্ত্রী চুলা লেপতে উঠে, তখনি লোক মুখে শুনতে পায় তার স্বামী হাসান ঢালী বাঘের আক্রমণে মারা গেছে।
আজ থেকে মুনজিলা হয়ে গেলে বাঘ বিধবা, শুরু হলো জীবণ সংগ্রাম। মুনজিলার জীবণ জীবিকা চলে কিভাবে জানতে চাইলে প্রথমে মুনজিলা জোরে একটা দৈর্ঘশাস্ব ছেড়ে বলেন, বাঘ বিধবার আর কিশের জীবন, আমার সংসার চলে নদীতে মাছের পোনা ধরে ও মানুষের বাড়িতে কাজ করে। এভাবেই চারটা ছেলে মেয়ে মানুষ করে আসছি।
বাঘ বিধবা বলে গ্রামের মানুষ তাকে অবহেলা করে কি না জানতে চাইলে মুনজিলা বলেন, প্রথমে আমার কেউ কাজে নিতো না, বলতো তুই তোর মতো চল। আমাদের ধারপারে আসবিনা। তখন খুব খারাপ লাগতো। তবে এখন আর কেউ এভাবে বলেনা। মুনজিলা বলেন, স্বামী মরার পর থেকে আজ পর্যন্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবণ চলছে। জানিনা এই কষ্ট কতদিন থাকবে আমার কপালে। তবুও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে সুন্দরবন উপকূলে মুনজিলার মতো শত শত বিধবারা।