নৌকা লাঙ্গলের প্রার্থীদের বিজয় রথ থামিয়ে দিতে পারে: সাতক্ষীরার নির্বাচনী মাঠে হেভিওয়েট চার বর্তমান-সাবেক সাংসদ

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মনোনীত ৮ প্রার্থী ছাড়াও সাতক্ষীরার চারটি আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন সাবেক ও বর্তমান চারজন সংসদ সদস্য। এরমধ্যে দু’জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং দু’জন দলীয় প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন। এসব প্রার্থীদের কমপক্ষে দু’জন নৌকা ও লাঙ্গলের প্রার্থীর গলার কাটা হয়ে উঠতে পারেন। নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা এসব প্রার্থীদের সাথে হতে পারে এমনটি মনে করেন অনেকে।

১৯৮৬ সালে সামরিক সরকার এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো বর্জন করে। সে সময়ে ক্ষমতাশীন জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগসহ ২৭টি দল সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৬১ দশমিক ১ শতাংশ। কথিত আছে উক্ত নির্বাচনে জনগণ স্বত:স্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করায় আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয় ফলাফল ঘোষণার সময় মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসন, আওয়ামী লীগ ৭৬ আসন, জামায়াত ১০ আসন, জাসদ (রব) ৪ আসন, মুসলিম লীগ ৪ আসন, আওয়ামী লীগের সমমনা দুই ন্যাপ ৮, কমিউনিস্ট পার্টি ৫, ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) ৩, জাসদ (সিরাজ) ৩ ও বাক্শাল ৩টিসহ ২১টি আসনে জয়লাভ করে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ৩২টি আসন।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে এবার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্পন্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনও একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে দৃশ্যত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ইতোমধ্যে সে ধরনের বক্তব্য বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রদান করেছেন। জনগণের ভোট নিয়েই প্রার্থীদেরকে জিততে হবে এমন ম্যাসেজও দেওয়া হয়েছে। ফলে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোর বর্জন সত্ত্বেও এবারের নির্বাচন পূর্বের দুটি নির্বাচনের মতো হবে না-এমনটি মনে করছেন অনেকে। যদি প্রশাসনের অবৈধ হস্তক্ষেপ ছাড়াই সে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরার চারটি আসনের নির্বাচনে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান দুইদল আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বাইরে হেভিওয়েট চার সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য। যাদের দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং দুইজন দলের প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন।

সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) নির্বাচনী এলাকায় ১২জন প্রতিদ্বন্দ্বীতাকারী প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য, ওয়ার্কার্স পাটির পলিট ব্যুরোর সদস্য এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। তিনি নৌকার প্রার্থী হিসেবে ২০১৪সালের দশম সংসদ নির্বাচনে ৯২ হাজার ২০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম মুজিবুর রহমান ঐ নির্বাচনে পেয়েছিলেন ২৩ হাজার ৬১৩ ভোট।

২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এই আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৬৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত জোটের হাবিবুল ইসলাম হাবিব পেয়েছিলেন ১৭ হাজার ৪৫৫ ভোট।
এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ তার দলীয় প্রতীক হাতুড়ি নিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন। সে নির্বাচনে তিনি ২ হাজার ৬১১ ভোট পেয়েছিলেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাতক্ষীরা-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নেমেছেন প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সাবেক এই সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ২০০৯ সালের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে তিনি ১ লাখ ৬৮ হাজার ২৯৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রার্থী হাবিবুল ইসলাম হাবিব পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৪ ভোট।
ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান এই আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ২০০১ সালের নির্বাচনে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫২৭ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থী হাবিবুল ইসলাম হাবিব।

এলাকায় ক্লিন ইমেজের ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। সাতক্ষীরায় দাপটের সাথে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ৩২ হাজার ৮৫৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল করিম সাবু পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ৭৮৯ ভোট।

সাতক্ষীরা সদর আসনে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬১১। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত জোটের আব্দুল খালেক মন্ডল পেয়েছিলেন ২৭ হাজার ৭১১ ভোট।
সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জের আংশিক) আসনে বিএনএম এর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য এইচএম গোলাম রেজা। তিনি জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির হুইপ ছিলেন। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় এই প্রভাবশালী শীর্ষ নেতা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ধারায় যোগ দেন এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম থেকে এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।

এইচএম গোলাম রেজা ২০০৯ সালের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ১ লাখ ৫১ হাজার ১৪৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত জোটের গাজী নজরুল ইসলাম পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৫ ভোট। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হলেও শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েন।
বর্তমান এবং সাবেক এই চারজন সংসদ সদস্যকে এখনো জোট মহাজোটের প্রার্থী দৌড়ে টিকিয়ে রেখেছেন অনেকে। তারপরও বর্তমান অবস্থান থেকে শেষ পর্যন্ত যদি নির্বাচনের মাঠে থেকেই যান তাহলে এদের কমপক্ষে দুজন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দলীয় প্রার্থীদের বিজয় রথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকে।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।