১০ ডিসেম্বর কেন আলোচনায়?

গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১০ ডিসেম্বর আলোচিত দিন হয়ে উঠেছে। ২০২১ সাল থেকে দিনটি এলে এক ধরনের রাজনৈতিক শঙ্কা তৈরি হয়। এ কারণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার দিবস ছাড়াও দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজধানীর প্রেসক্লাবে বিএনপির মানববন্ধনকে ঘিরে সারগরম হয়ে পড়ছে রাজনৈতিক আলোচনার টেবিল। গত বছরও এই দিনকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা, তৎপরতা ও শঙ্কা বিরাজ করেছিলো রাজনৈতিক মহলে।

যদিও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার রক্ষার এই দিনটি। ৭১-এ ভোটাধিকার, মৌলিক নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অপমার জনসাধারণ। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন শুরু করে ২৫ মার্চের কালোরাত্রি থেকেই। এরপর সর্বশেষ ৭১-এর ১০ ডিসেম্বর সম্ভাব্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেন শিরদারা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শুরু হয় বুদ্ধিজীবি নিধন। অর্থাৎ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিকভাবে উদযাপিত মানবাধিকার দিবসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সঙ্গেই বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস মিশে আছে।

সেই সময় এই ভূখণ্ডে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিলো সর্বনিম্ন ১৬১৬ কিলোমিটার দূরত্বের (বাংলাদেশের হরিপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তান পাঞ্জাবের কাসুর সীমান্তবর্তী এলাকা পর্যন্ত সোজা হাঁটাপথে সর্বনিম্ন এই দূরত্ব) পাকিস্তান ভূখণ্ডের শাসকরা। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও মানবাধিকার ও আইনের শাসন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে দেশে। আজ রবিবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। অতীতের যেকোনো সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ-তৎপরতা দেখা না গেলেও ২০২১ সালের পর থেকে এই দিবস নিয়ে বিশেষ উৎসাহ লক্ষণীয়। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও আইনপ্রয়োগকারী এই সংস্থাটির শীর্ষ ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকেই মূলত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এই দিনটি।

টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশ সরকারের ওপর পশ্চিমা বিশ্বসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থার পর্যবেক্ষণে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকায় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি সংশ্লিষ্টতায় গুম, খুন ও বিধিবহির্ভূত মিথ্যা মামলায় হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকায় হেফাজতের মহাসমাবেশকে ঘিরেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। ওই বছর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে ৬১জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ব্যাপক সমালোচনা করে। শেষপর্যন্ত উচ্চ আদালতের রায়ে গত ১৫ অক্টোবর জামিনে মুক্তি পান আদিলুর রহমান খান ও তার সহকর্মী নাসির উদ্দিন।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকের মধ্যে বাংলাদেশের অগ্রসর হচ্ছে। নানাদিকে নানারকম আতঙ্ক, উদ্বেগ ও এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ধুম্রজাল। বিশেষ করে গত ২১ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশের পর এ শঙ্কা আরও শক্তপোক্ত হয়ে দানা বাঁধে। ফলে মানবাধিকার দিবসকে ঘিরে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজও বৈদেশিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে আছেন। শঙ্কার মুখে পড়ছে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত।

মূলত র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে এই দিনটিকে র্টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নিয়েছে বিএনপি ও সরকার বিরোধী মিত্র দলগুলো। কেননা, দেশি-বেদিশে পর্যবেক্ষণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকাংশ অভিযোগগুলো বিএনপি ও বিরোধী মতের মানুষের বিরুদ্ধেই সংঘটিত হয়েছে বলে তথ্য উঠেছে। গত বছর এই দিনে ঢাকায় মহাসমাবেশ করেছিলো বিএনপি। সমাবেশের আগে বিএনপির নেতার ঘোষণা ’১০ তারিখের পর দেশ চালাবেন খালেদা জিয়া’ দলটির নেতাকর্মীদের যেমন উদ্বুদ্ধ করে তেমনি রাজনৈতিক সচেতন মহলে আশঙ্কাও তৈরি হয় এ নিয়ে। রাজধানীর গোলাপবাগের ওই সমাবেশ থেকে বর্তমান সংসদ বিলুপ্তির দাবি জানিয়ে বিএনপির ছয় সংসদ সদস্য পদত্যাগের ঘোষণা দেয়। এছাড়াও গুম হওয়া নাগরিকদের উদ্ধার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার, ডিজিটাল নিরাপত্ত আইন বাতিল, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিরোধী রাজবন্দী ও লেখক-সাংবাদিকদের মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায় দলটি। সমাবেশের আগে দলটির প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ বছরও ইতোমধ্যে নানা জল্পনা কল্পনা তৈরি হয়েছে ১০ ডিসেম্বর ঘিরে।

চলতি বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে মৌলিক মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের মানদণ্ডের প্রতি সম্মান দেখানোর ঘাটতির বিষয়টি জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও সুশীল সমাজের প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে। এরই মধ্যে কম্বোডিয়ায় আংশিক জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করেছে ইইউ। মিয়ানমারেরর সঙ্গেও আর্থিক সহযোগিতা সংকুচিত করেছে সংস্থাটি। এ কারণে এবারের মানবাধিকার দিবসকে ঘিরে বাংলেদেশের রাজনীতিতে উত্তাপ বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ করে রপ্তানি খাত অতিমাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল। অন্যান্য বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন ও ভারতের সঙ্গে উল্টো আমদানি নির্ভরতার কারণে চাপের মুখে দেশের অর্থনীতি। কেননা রপ্তানি আয় বন্ধ হলে কিংবা সংকুচিত হলে আমদানি দায় মেটানো জটিল হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে রিজার্ভ সংকটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। মূলত এসব কারণেই দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সমাজ উদ্বিগ্ন সময় পাড় করছেন। বারবার সতর্ক করছেন সরকার ও অংশীজনদের। দেশি-বিদেশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোও দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, শ্রমিক অধিকার, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ‍তুলছে এবং অ্যামেনেস্টিসহ একাধিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক রাজিনৈতিক নেতারা বিভিন্ন শক্তিকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে আসছে।

সর্বশেষ গত সপ্তাহে এক ইউরোপীয় পার্লামেন্টারিয়ান আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার হয়রানি ও ধড়পাকড় বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদার মুক্তি ও অবাধ, নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া শ্রমিক অধিকার নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। অন্যথায় বৈদিশ বাণ্যিজসহ বাংলাদেশ নানা নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে বলে সতর্কও করেছেন। মূলত বিদেশিদের তৎপরতায় আশা দেখছেন বিএনপিও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। তারা আশা করছেন দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে সরকার সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিবে।

তবে এসব আলোচনা-সমালোচনা ও শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, দেশি-বিদেশি চাপ থাকলেও উদ্বিগ্ন নয় আওয়ামী লীগ। যত ষড়যন্ত্রই হোক, সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে অটল থাকবে আওয়ামী লীগ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের যৌক্তিক কারণ দেখছি না। যারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।