আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সরিষার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরায়। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে চাষ করা হয়েছে সরিষার। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু সরিষা ফুলের হলুদের সমারোহ। সরিষার হলুদ ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে মধু সংগ্রহ করতে উড়তে দেখা যাচ্ছে মৌমাছিদের। চাষের সময় আর খরচ দুটোই কম হওয়ায় কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় সরিষা চাষ। গত কয়েক বছরে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে শস্যটির ফলনও আগের চেয়ে বেড়েছে। এ কারণে সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দিন দিন বাড়ছে সরিষার চাষ। ২০২৩-২৪ মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় ২১ হাজার ৭৬৭ দশমিক ২ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। যেখানে ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৮ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল। ফলে ৬ বছরে জেলায় সরিষার আবাদ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাজারে দাম ভালো থাকায় সরিষায় আশার আলো দেখছেন কৃষকরা। তবে সরিষা ফুল ও সরিষা শাকের কদর থাকায় সেই ফুল ও শাক বিক্রি করে বাড়তি উপার্জন করছেন কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে বার্ষিক ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৬ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদন মাত্র দুই লাখ টন। বাকি ১৪ লাখ টন তেল বিদেশ থেকে আমদানি করতে খরচ হয় ২৭ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতাা কমাতে সরিষাকে বিকল্প হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ফসলটির উৎপাদন বাড়াতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সরিষার উৎপাদন বাড়িয়ে দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব বলছে কৃষকরা। কৃষি বিভাগ বলছে, প্রচলিত দেশি সরিষার চেয়ে বারি ও বিনার উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলোর ফলন বেশি। এ কারণে এতে চাষিরাও আগ্রহী হচ্ছেন। অনেকেই আমন ধান সংগ্রহের পর জমি ফেলে না রেখে সরিষা চাষ করছেন। এরপর আবার বোরো ধান রোপণ করতে পারছেন। এতে একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কয়েক বছরে বেশকিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, বিনার সরিষা হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১ দশমিক ৮ টন। জীবনকাল মাত্র ৮৭ দিন। বাড়তি ফলন ও কম সময়ের কারণে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে দেখা গেছে, এবার ভুট্টা ও আলু চাষের পাশাপাশি সরিষা চাষও হয়েছে ব্যাপকহারে, যা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি। ফলে এ বছর সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েকজন সরিষা চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবহাওয়া ভালো থাকলে ১ বিঘা জমিতে প্রায় ৫ থেকে ৭ মণ করে সরিষার ফলন হয় এবং সরিষা চাষে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়। ফলে খরচের তুলনায় লাভ বেশি থাকায় সরিষা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা।
সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জেলায় চলতি মৌসুমে ২১ হাজার ৭৬৭ দশমিক ২ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ, ২৮ হাজার ৯৫০ মে. টন উৎপাদন এবং হেক্টর প্রতি (১.৩৩) এক দশমিক তেত্রিশ মেট্রিক টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তথ্য সুত্রে, বিদেশ থেকে আমদাণী সংকোচিত করার লক্ষ্যে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাতক্ষীরার ৭টি উপজেলায় সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সাতক্ষীরা। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় সরিষা ৬৭০০ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ৮৯১১ মেঃ টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কলারোয়া উপজেলায় সরিষা ৮৩৬৭ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ১১১২৮ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তালা উপজেলায় সরিষা ২০০০ হেক্টর হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ২৬৬০ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেবহাটা উপজেলায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ১৯৯৫ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কালিগঞ্জ উপজেলায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ১৯৯৫ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আশাশুনি উপজেলায় ৯০০ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ১১৯৭ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলায় সরিষা ৮০০.২ হেক্টর জমিতে আবাদ এবং উৎপাদন ১০৬৪.৩ মে. টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সাতটি উপজেলায় সূর্যমুখী ১৫০ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং হেক্টর প্রতি সরিষা ১.৩৩ মে. টন এবং সূর্যমুখী ২.২৫ মে. টন ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অল্প দিনের মধ্যে যেন কৃষকগণ সরিষার চাষ করে সহজে বোরো ধান চাষ করতে পারে সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কৃষিমন্ত্রী ও ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ভোজ্যতেলের চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় । তিনি বলেছেন, এ অবস্থায় দেশে ৫০ ভাগ তেল উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানি নির্ভরতা কমাতে তিন বছর মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি আমরা। প্রথম বছরেই এবার সারাদেশে দ্বিগুণ পরিমাণ সরিষা চাষ হয়েছে। সরিষা চাষে বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে এবং আগামী তিন বছরের মধ্যেই আমরা বছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারব।