অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও বিএনপির যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্ন

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক এ প্রত্যাশা সবার। বিগত কয়েকমাস ধরে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ দাবি ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করে আসছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর, বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান পিটার হাস, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিনিধিরা বারবার বলছে, তাদের চাওয়া বাংলাদেশের মানুষ যা চায় তাই, তাদের বক্তব্য বিশেষ কোনো দলের পক্ষে নয়, বরং তাদের প্রত্যাশা অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদ নির্বাচন। এটা সবারই জানা ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাসহ মনোনয়নের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। মনোনয়নের নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলসহ অনেক স্বতন্ত্র ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এবারের নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় তার কৌশল হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নের বাইরে আওয়ামী লীগ তার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুমতি প্রদান করেছে। এ হিসেবে একই নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের একাধিক প্রার্থী আছে। এতদসত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনের সাথে তাদের সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে পুনরায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপর জোর প্রদান ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে।

অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে একই কথা বলেছেন। গত ২ ডিসেম্বর-এ প্রদত্ত জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্রের বক্তব্য ছিল এরূপ যে, ‘বাংলাদেশের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থাৎ সবার অংশগ্রহণে এবং শান্তিপূর্ণ’। ইংরেজী বাক্যটি ছিল ‘The inclusive election be inclusive and peaceful’.
তাদের এসব বক্তব্যের আলোকে এই ধারণা কি অযৌক্তিক হবে যে যেহেতু বিএনপি আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেনা তাই তারা সঠিক অর্থে এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলতে নারাজ। কারণ তাদের বিশ্বাস নির্বাচন সঠিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক হতে হলে বিএনপির মতো বৃহৎ জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, বস্তুত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে কি বুঝায়, তার পরিধি কি? বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা কতটুকু? এ বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

রাজনীতি বিজ্ঞানের ভাষা অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো রিপ্রেজেন্টেটিভ তথা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। প্রতিনিধিত্বশীল বলতে বুঝায় জন প্রতিনিধিত্বশীল। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের বক্তব্য এর সুস্পষ্ট উচ্চারণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক আদর্শ ভিত্তিক সকল দেশেই এ ব্যবস্থার চর্চা বিদ্যমান। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের মূল কথা ‘হোক সেটা সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি শাসিত’ জনগণ তাদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। নির্বাচনের ধরণ বা প্রকৃতি কেমন হবে এ সম্পর্কে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্রের অনুচ্ছেদ ২১(৩) ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ২৫(খ) তে বলা হয়েছে এটি হবে ‘genuine’ যেখানে সকল ভোটদাতার মুক্ত অবাধ ইচ্ছা প্রকাশের নিশ্চয়তা থাকবে। আমেরিকান ডিকলারেশন অব দি রাইটস এ্যান্ড ডিউটিস অব ম্যান এর অনুচ্ছেদ ২০ এ বলা হয়েছে নির্বাচনটি হবে popular বা জনপ্রিয়।
জন প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনীতিক দলসমূহ কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভূমিকা পালন করে, অর্থাৎ জনগণ নির্বাচনে রাজনীতিক দলের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে, স্বতন্ত্র ব্যক্তি বিশেষের প্রতি সমর্থন এখানে গৌণ। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী রবার্ট ডালী, জর্জ হাউস্টন এবং আয়ান লেইবেনবার্গ এ ব্যবস্থাকে ‘polyarchy’ বলে অভিহিত করেছেন। Polyarchy হলো এমন ব্যবস্থা যেখানে সরকার গঠনে বহু জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকে। প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এটি হলো সারবস্তু। এই পরিপ্রেক্ষিতে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন হবে বহুমাত্রিক, অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক। যেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে, জনগণের ভোটে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে, বিজিত দল রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ক্ষমতার মূল কেন্দ্র সংসদে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।
আবার মূল প্রশ্নে আসা যাক যে, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রকৃতার্থে অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে কি না? এর উত্তর এক কথায় ‘না’।  উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যা সহজে প্রতীয়মান হয়। কারণ এটা স্পষ্ট যে এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো দল নেই। ভোটের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন এককভাবে আনুমানিক ৪০ শতাংশের উপর। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দলের মধ্যে জাতীয় পার্টির কিছুটা শতকরা আনুপাতিক জনসমর্থন ছিল। তবে বিগত সংসদসমূহে লেজুড়ভিত্তিমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের দরুণ তাদের জনসমর্থন এখন অনেকটা শুন্যের কোটায়। বিগত উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী একমাত্র রংপুর ছাড়া তাদের কোথাও প্রতিনিধিত্বশীল জনসমর্থন নেই। অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দল যেমন তৃনমূল বিএনপি, সদ্য প্রসূত বিএনএম, সুপ্রিম পার্টি এবং কিছু ইসলামিক দল বা জোট যাদের জনসমর্থন ও ভোট প্রাপ্তির সম্ভাবনা শতাংশের পরিসংখ্যানে পরিমাপ করা যায় না।
আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনের বাইরে থাকা বিএনপিই এদেশের জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল যাদের জনসমর্থন ও ভোটের পরিমাণ আওয়ামী লীগের অনুরূপ। বিএনপি সহ যে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না তাদের সম্মিলিত জনসমর্থন আনুমানিক ৫০ শতাংশের উপরে। বিএনপি বিগত দেড় দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা ও রাজনৈতিকভাবে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা অব্যাহতভাবে দমন ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে সাংগঠনিক নেতৃত্বে কিছুটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে কথাটি সত্য, কিন্তু তাদের বিশাল জনসমর্থনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এ অবস্থায় বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে আসন্ন সংসদীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ বিচারে অংশগ্রহণমূলক হওয়া অসম্ভব। কেননা তাদের নির্বাচন বয়কট করার দরুণ বিশাল এক জনগোষ্ঠী তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়া থেকে বঞ্চিত হবে। আমার ধারণা, জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য ‘The inclusive election be inclusive’এ বিষয়টির প্রতি জোরালো ইঙ্গিত।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৪৪টি নিবন্ধিত দলের ২৯টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে যা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তাহলে সংখ্যানুপাতে কি এ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নয়? উত্তর হলো, অজনপ্রতিনিধিত্বশীল দলীয় সংখ্যাধিক্যের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কোন নির্বাচনকে সঠিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় না। কেননা তার দ্বারা সকল জনগণের সক্রিয় ও কার্যকরী অংশগ্রহণ প্রমাণিত হয় না। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ এর আলোকে বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ‘effective participation’ তথা সক্রিয় ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না বিধায় এ নির্বাচনকে সঠিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায় না। এক্ষেত্রে empirical গবেষণার representative data বা authentic data theory টি প্রয়োগ করা যায়।
মজার কথা হলো, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল যদিও সংখ্যানুপাতে অনেক, কিন্তু বাস্তবে এক দল কেন্দ্রিক নির্বাচন হচ্ছে। সেটা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল সমূহের আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগির দেন-দরবার ও দৌড়-ঝাপ দেখে যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে, আওয়ামী লীগ একক দল হিসেবে নির্বাচন করছে। তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। অন্য অংশগ্রহণকারী দলসমূহ আওয়ামী লীগের বি-টিম বা উপদলের মতো। সংসদে দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধী দলের অভিনয়কারী জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগের সাথে সিট ভাগ-বাটোয়ারার দিবা-নৈশ বৈঠকে ব্যস্ত। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের ড্যামি প্রার্থীরাও দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন করছে। কিংস পার্টির প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধানের আশ্বাস ও আশীর্বাদ নিয়ে নির্বাচন করছে। এ অবস্থায় কিভাবে এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বলা যায় যেখানে জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের পূর্বে সমঝোতার মাধ্যমে কে কোথায় নির্বাচিত হবে তা নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। তাই অবস্থারদৃষ্টে এ নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটাররা অংশগ্রহণ করবে, পূর্ব নির্ধারিত পলিসি অনুসারে ভোটে আওয়ামী লীগসহ সকল দলের জয়-পরাজয় নির্ধারণ হবে। তাই এ নির্বাচনকে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের সাথে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে না। এ প্রসঙ্গে চ্যানেল ২৪ এর সাথে সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের জনৈক অধ্যাপকের মন্তব্য খুবই প্রনিধানযোগ্য। তার সাক্ষাৎকারে সংবিধানের দোহাই দিয়ে এ ধরণের আপোষ কামিতার নির্বাচনকে তিনি গণতন্ত্রের দৈন্য দশা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে প্রতিযোগিতাবিহীন কোনো নির্বাচন গণতান্ত্রিক নির্বাচন হতে পারে না। একশ কথার এক কথা।
তাই পরিশেষে বলা যায় যে, কোনো বিবেচনায়ই বিএনপি ছাড়া আসন্ন নির্বাচন সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না। এমনটি যদি হতো, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ অন্তত: পক্ষে ৭৫ শতাংশ জনসমর্থনের প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে majority theory এর ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বলা যেতে পারত।

 

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Check Also

সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা, দস্তরবন্দি, সম্মাননা প্রদান ও মিলন মেলা অনুষ্ঠিত

আব্দুল করিম,নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার হিফজুল কুরআন বিভাগের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।