ইবরাহীম খলিল : রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এখন দেশের আনাচে-কানাচে। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শহরের ফুটপাতসহ সবখানে। এমনকি ড্রইংরুমেও মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোনো কমতি নেই। বাবা ফোন করছেন মেয়েকে, সন্তানরা বাবাকে, পরিবারের প্রতিটি মানুষ একে-অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত। কমবেশি দেশের অধিকাংশ মানুষই চিন্তামগ্ন, অনেকেই ঘুমহীন। এ অবস্থার পরিবর্তন কবে হবেম কেউ বলতে পারেন না।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক আমরা। বিজয়ের ৫২ বছর অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। অর্ধশতাব্দী একটি দেশের জন্য খুব কম সময় নয়। নাগরিকদের সক্রিয় প্রচেষ্টায় দেশ অনেক এগিয়েছে। কিন্তু রাজনীতির দিক থেকে বিবেচনা করলে যেখানে বাংলাদেশ একটি পরিণত দেশে পরিণত হতে পারত সেদিক থেকে ৫২ বছরেও যেন শিশুই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। এখনো জনতার বিজয় আসেনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। দেশে রাজনীতি আজও বন্দী। ক্ষমতালিপ্সু একটি চক্র আধিপত্যবাদী অপশক্তির হাতে- এমনটাই মনে করেন দেশের সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে তাদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। অভিমতগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
১১ ডিসেম্বর রোববার। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ রেলস্টেশনের পেছনে সকাল ৯টার দিকে চায়ের দোকানে বসে এ প্রতিবেদক। ট্রেনের অপেক্ষায় রত বেশকিছু যাত্রী এবং স্থানীয় ময়-মুরুব্বি বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু পেঁয়াজের দাম। বাদ যাচ্ছে না দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ। সরকার ঘোষিত নির্বাচন সামনে থাকায় ঘুরেফিরে সামনে আসছে দেশের রাজনীতি। এ প্রতিবেদক কান পেতে আছে সেদিকেই। কথা প্রসঙ্গে স্থানীয় মুরুব্বি শামছুদ্দিন ঠাণ্ডা কাশি দিতে দিতে বললেন, অনেক কিছু পাইছি। কিন্তু দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে তো সবই হাওয়া হয়ে যায়। দেশের রাজনীতিটাই ঠিক হলো না। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সবকিছু শেষ করে দিল। ৫২ বছর পরও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ দেওয়া লাগে। সবাই ক্ষমতার পাগল। যেকোনো উপায়েই। কেউ জানতে চায় না, দেশের মানুষ কী চায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ শুধু ভোগ করতে চায়। শুধু দেশ থেকে নিতে চায়। পাশ থেকে ট্রেনের যাত্রী মুমিন মাস্টার বলেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক হিসেবে আমরা স্বাধীনতা, অধিকার ও সুশাসন চাই। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ ভিন্নমতের মানুষ নিজের বাড়িতে থাকতে পারছে না। কেউ কেউ রাতের বেলা বন-বাদাড়ে রাত কাটায়।
এদিন কাওরাইদ থেকে একটি লোকাল ট্রেনে ঢাকায় আসেন এ প্রতিবেদক। সেখানেও রাজনৈতিক আলোচনার দিকে কান পেতে থাকেন পেশাগত প্রয়োজনেই। ঢাকার কমলাপুর আসতে ট্রেনটিতে অন্তত অর্ধ ডজন স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করেন। সেখানেও রাজনীতির আলোচনা বাদ যায় না। শ্রীপুর থেকে উঠেছিলেন বেসরকারি চাকুরে আবদুল ওহাব। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশোর্ধ। আগে থেকে চলতে থাকা রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেন তিনি সিটে বসার ২০ মিনিটের মধ্যেই। তার বক্তব্য হলো, রাজনীতি যদি আপসের বিষয় হয়, আমরা এ কথা কখনো শুনি না; নির্বাচন যদি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হয়, আমরা তা চর্চা করি না; গণতন্ত্র যদি সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয় হয়, সেই নিশ্চয়তা আমরা দিতে চাই না। যে সমস্যার সমাধান আমরা ৩ দশকে করতে পারিনি, তা কি আগামী কয়েকদিনে করতে পারব? যদি ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের ওপর এর কী প্রভাব পড়বে?
টঙ্গী থেকে ট্রেনে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেদায়েত উল্লাহ। ভদ্রলোকের বয়স ৮০ বছরের মতো হবে। তিনিও বাদ গেলেন না রাজনীতির আলোচনা থেকে। ভদ্রলোকের মুখে আফসোস। বললেন, দলীয়করণ যে রূপ লাভ করেছে, তাতে বর্তমান প্রশাসনব্যবস্থা, পুলিশ বাহিনী, র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন সম্ভব হবে না। গত ৫০ বছরের ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে, প্রতিটি নির্বাচনের পরই রাজনীতির নিম্নগামিতা বাড়ছে। এর ফলে আজকের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যে শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি রূপে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার শক্তি নিতান্ত অবহেলাযোগ্য নয়। বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের অভাব দেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলছে।
ভদ্রলোকের মূল কথা হলো, রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতি থেকে রাজনীতিটাই নাই হয়ে গেছে। রাজনীতিকদের মধ্যে যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। তারা নিজেরা তা দেখতে পাচ্ছেন না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো কথা না থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনে বিদেশি কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যেকোনো ধরনের চুক্তিতে যেতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকাটাকেই নিশ্চিত করতে হবে।
বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা যাত্রী এবং কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, ৫২ বছরে আমাদের আবেগকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক শক্তি। সবাই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এদেশের জনগণকে সিঁড়ি বানিয়েছে। কেউ জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে কোনো মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা কী? ক্ষমতাসীন কিংবা বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ বলবে না যে দ্রব্যমূল্য।
জনগণের ভোটাধিকার ও অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে জনগণও বিভ্রান্ত। মূলত একটি বড় অংশের জনগণই বিরাজনীতিকীকরণে প্রভাবিত। তারা মনেই করে এদেশে গণতান্ত্রিক যে বিধি ব্যবস্থা চলছে, তা সঠিক নয়। কেবল ভোটাধিকারের ওপর এদেশের জনগণের আর আস্থা আছে বলে আমার মনে হয় না। ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে কমলাপুর স্টেশনে নেমে বসেন স্টেশনের ভেতরের একটি চায়ের দোকানে। এখানে আসেন হাজার রকমের মানুষ। সেখানেও শুরু হয় রাজনীতির আলাপ। রেলওয়ের এক কর্মকর্তার সাথে দেখা। নাম প্রকাশ না করেই কিছু মন্তব্য করেন। তা হলো, আজও খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে ইচ্ছে করে আমরা কী সংঘাত নাকি শান্তি চাই। নিশ্চয়ই এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তাই যেকোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে আমরা এড়াতে চাই। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে এখন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের জীবন গেল। যে পুলিশ ভাইটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, এটি যেমন আমরা সমর্থন করি না। ঠিক একইভাবে সারা দেশে নির্বিচারে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়নকেও আমরা সমর্থন করি না। সারা দেশে অবরোধ চলছে, প্রতিদিনই অস্থিরতা বাড়ছে। আমেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর তাবৎ দেশ বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নানারকম বক্তব্য রেখেই যাচ্ছে। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের হর্তা-কর্তা হিসেবে তারা নিজেদের দাঁড় করিয়েছে। আমাদের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতালিপ্সু শক্তি দুটিই সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, অপরাধ বিশ্লেষক।
Check Also
তাবলীগ জামায়াতের সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ-সমাবেশ
মুহাম্মদ হাফিজ, সাতক্ষীরা : তাবলীগ জামাতে সাদপন্থীদের বর্বোরিচত হামলার প্রতিবাদ ও সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সহসভাপতি …