কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকার বড় মসজিদের মিনারের পাশেই নতুন চায়ের দোকান দিয়েছেন আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। মহল্লার লোকজন এক নামেই চেনেন তাকে।
জল্লাদ শাহজাহানের হাতে ফাঁসিতে ঝুলেছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বহু আসামি, এদের মধ্যে যেমন রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীরা তেমন রয়েছে বড় বড় জঙ্গি নেতারা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিও কার্যকর করেছেন এই জল্লাদ।
যার ভয়ে কাঁপত সাধারণ কয়েদিরা, সেই জল্লাদ এখন চায়ের দোকানদার। শাহজাহানের চায়ের দোকানটি একেবারেই নতুন, দোকানে এখনো লেগে আছে নতুন আসবাবের গন্ধ। রং চা, গরুর দুধের চা, কনডেন্স মিল্ক এই তিন ধরনের চা পাওয়া যায় তার এখানে।
মানুষ এখানে যতোটা না চা খেতে আসে তার চেয়ে বেশি আসে জল্লাদকে দেখতে। চা খেতে খেতে কেউ তার সাথে ছবি তোলে, কেউ সেলফি তোলে হাসিমুখে। এসবে এখন অভ্যস্ত শাহজাহান।
কেন চা দোকান দিলেন শাহজাহান এমন প্রশ্নের জবাবে শাহজাহান বললেন, ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকেই চা খাওয়া শিখেছি। মাটিতে পাটি বিছাইয়া চা-মুড়ি সামনে রাইখা বসাইয়া রাখতো মা। সেই যে চা খাওয়ার অভ্যাস হইছে, সেটা আর ভুলতে পারি না। বলতে পারেন চা আমার নেশা। এই নেশাটা আরও বাড়ছে জেল জীবনে। জেলে চা না খাইলে আমার ঘুম আসতো না।
তিনি আরও বলেন, জেলে মাথার কাছে একটা চায়ের কেটলি রাখতাম। যেন ঘুম ভাঙলেই চা খাইতে পারি। যেদিন চা খাইতে না পারতাম, সারাটা দিন আমার মাথা ব্যথা করতো। আমি চা বানাইতে ভালো পারি। তাই চায়ের দোকান নিয়া বসছি। নিজে খাইলাম, অন্যদেরও খাওয়ালাম। এই চিন্তা থেকেই চায়ের দোকানি হইলাম।
দোকানের বাইরে শাহজাহানের অবসর এখন কাটে মান্না দে, ভূপেন, কিশোর কুমার, হেমন্তর গান শুনে। আগেও বিয়ে করেননি, আর বাকি জীবনেও নিজেকে মায়ার বাঁধনে বাঁধতে চান না।
কে এই জল্লাদ শাহজাহান
কারাগারের রেকর্ড বলছে, ২০০১ সাল থেকে মুক্তির আগ পর্যন্ত জল্লাদ শাহজাহান ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যদিও তার দাবি এই সংখ্যা ৬০। তবে দুই পরিসংখ্যানেই দেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়ার।
তিনি যাদের ফাঁসি কার্যকর করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী ও জেএমবির দুই জঙ্গি বাংলা ভাই ও আতাউর রহমান সানী।
শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ডাকাতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরিচিতি পান ডাকাত হিসেবে।
শাহজাহারের তিন বোন, এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া ও মা মেহের। ১৯৭৪ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন শাহজাহান।
একবার তার গ্রামে নারীঘটিত ঘটনায় দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে গ্রামে বিচারে বসে। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সাজা হয় তার। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেনে। অপরাধ জগতে জড়িয়ে চরম প্রতিশোধ নেয়ার খেলায় মেতে ওঠেন তিন।
সেই ধারায় ক্রমেই দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠে যায় শাহজাহানের। তার উল্লেখযোগ্য একটি ডাকাতির অপারেশন ছিলো ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। আর এটাই ছিলো তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। কারণ, এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হয় তাকে।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে যান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্ত হয়। এরপর থেকে শুরু হয় তার বন্দী জীবন।
রেকর্ড অনুযায়ী দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শাহজাহান ভূঁইয়া। একটি ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা মামলা এবং আরেকটি অস্ত্র আইনে মামলা। এ দুটি মামলায় ১৯৯১ সালের ১৭ মে থেকে কারাগারে ছিলেন শাহজাহান। দুই মামলায় তার সাজা হয়েছিল ৪২ বছর।
এর মধ্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে অস্ত্র আইনে মামলায় তার ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার অনাদায়ে আরও ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। আর হত্যা মামলায় তার ৩০ বছরের সাজা হয় এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস কারাদণ্ড হয়।
এই দুই মামলায় ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত পেয়েছেন তিনি। শাহজাহানের হাতে কোনো টাকাপয়সা না থাকায় যে ১০ হাজার টাকা তাঁর দণ্ড হয়েছিল, তা কারা কর্তৃপক্ষ মিটিয়ে দিয়েছে।
সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় আসলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেয়।
এ সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জল্লাদের কাজ দিয়েছিলো। আমি সাহসী ছিলাম বলেই, এই কাজ পেয়েছিলাম। কাজটি আমি না করলে কেউ না কেউ করতেন। এখন আমি চলে এসেছি, এ কাজ অন্যরা করবেন।
কারা কর্তৃপক্ষ তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে জানিয়ে শাহজাহান বলেন, আমি কারাগারে ভালো ছিলাম।
কারাবিধি অনুযায়ী, আচার-আচরণ এবং অন্যান্য কারণে সব মিলিয়ে ১০ বছর ৫ মাস রেয়াত পেয়ে জল্লাদ শাহজাহান সাজা খেটেছেন মোট ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন। এ বছরের ১৮ জুন কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি মেলে শাহজাহান ভূঁইয়ার।