মুহাম্মদ নূরে আলম
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বছরজুড়ে ছিল পশ্চিমা কূটনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা। সবচেয়ে বেশি সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতিও দিয়েছে দেশটি। এসব তৎপরতার জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার অঙ্গীকার জানানো হয়। তা সত্ত্বেও বর্তমান ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ সরকার একরতফাভাবে নির্বাচন করতে যাচ্ছে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররাসহ প্রায় ৬০ রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না কারণ দলীয় সরকারের অধীনে অতীতে একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ইতোমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমার সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে বিএনপি-জামায়াতকে ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নির্বাচন ঘিরে কূটনীতিকদের প্রকাশ্য তৎপরতা লক্ষ্য করার মতো। অনেক দেশই এই একরতফা নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এই দেশগুলো সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমন বাস্তবতায় ২০২৩ সালে বছরজুড়েই সরকারকে নানামুখী চাপ সামলাতে হয়েছে, যে ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। অর্থনীতি-বাণিজ্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ এবং বিভিন্ন অংশীদারিত্ব ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু হিসেবে হয়ে উঠছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। লক্ষ্য করা যায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোরও স্বার্থ এই অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব নিয়ে একইসঙ্গে সতর্ক ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদ জানিয়েছেন সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের পরামর্শ দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে সামনে এনে এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে দেশের পররাষ্ট্রনীতি। ভারত, চীন, রাশিয়া, মিয়ানমার ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় বছরজুড়ে বাংলাদেশকে কী ধরনের চাপ সামলাতে হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
ঢাকা-ওয়াশিংটন: নির্বাচন ইস্যুতে ২০২৩ সালের ২৭ মে বাংলাদেশের উদ্দেশে নতুন ভিসানীতি আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই ভিসানীতিতে বলা হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া’কে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে দায়ী বা জড়িত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা এই ভিসানীতির আওতায় রয়েছেন। এর পরপরই গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ঢাকা সফর করেছিলেন। দেশটির মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’ও ছিলেন এই সফরে। এরপর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকেই এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে বৈঠক করেছেন এবং সরাসরি গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। দেশের সুশীল নাগরিক সমাজের সঙ্গেও ব্যস্ত সময় পার করেছেন তিনি।
একইসঙ্গে এ বছরের শেষে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি। বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার রক্ষায় গত ১৬ নবেম্বর নতুন নীতি ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। এই শ্রমনীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যেসব দেশে বা যারা শ্রম অধিকার ক্ষুণœ করবেন, শ্রমিকদের ক্ষতি বা আক্রমণ করবেন তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যনীতি ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেসময় উদাহরণ হিসেবে বিশেষ করে বাংলাদেশের নাম টেনে আনেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ২০ নবেম্বর চিঠি পাঠিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস। পরবর্তী সময়ে ঢাকা এবং ওয়াশিংটনে বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক বৈঠকের খবরও জানা গেছে। এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা আনে পরাশক্তিধর এই দেশটি। সেসময় র্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বলে গত ৯ নবেম্বর বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল। ব্রিফিংয়ে বেদান্ত প্যাটেলের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। দৃশ্যমান সাফল্যও পেয়েছে। বাংলাদেশের এ অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাফল্যকে মার্কিন প্রশাসন কীভাবে মূল্যায়ন করে?
যুক্তরাষ্ট্র ‘ম্যানেজড’ নয়, বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের আটক ও নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে গত ১৩ ডিসেম্বর স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার যেভাবে বিরোধীদল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভুয়া সংবাদ এবং ভিডিও বানিয়ে প্রচার করেছে সেটি এক ধরনের উদ্বেগজনক প্রবণতা বলে মন্তব্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গণহারে গ্রেফতার এবং কারাগারের ভিতর নির্যাতনের ঘটনার বিষয়টি তাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সকল পক্ষ যেনো স্বাধীনভাবে, হয়রানি এবং সহিংসতা মুক্ত নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে নির্বাচনের আগে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে একাধিক প্রশ্ন করেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট করেসপন্ডেন্ট মুশফিকুল ফজল আনসারী। গত বছরজুড়ে মার্কিন সেস্ট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশে একটি সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার মার্কিন কোনো কথাই কানে না নিয়ে একতরফা ভাবে নির্বাচনের আয়োজন করে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ম্যানেজড হয়ে গেছে মর্মে প্রচারণা চালাচ্ছিলো ক্ষমতাসীনরা। গত ২৪ নবেম্বর, সিলেটে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, নির্বাচনের পর তারা নতুন সরকার গঠিন করলে সেই সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিবে বলে তিনি মনে করেন। গত ১২ ডিসেম্বর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব কেটে গেছে।
ঢাকা-ইউরোপীয় ইউনিয়ন: সেন্ট্রাল ইউরোপ ও মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বেশিরভাগ দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষে গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। তিন দশক পর বাংলাদেশে ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই সফরকে অংশীদারিত্বের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ঢাকা-প্যারিস। ঢাকায় ইইউ’র মূল এজেন্ডা পোশাক খাত। শুল্কমুক্ত পণ্য হওয়ায় দেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ইইউ। তবে উন্নত দেশ হওয়ায় ইইউ’র সদস্য রাষ্ট্রগুলো বরাবরই বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার, সুশাসন এবং গণতন্ত্র নিয়ে সোচ্চার। একইসঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোতে মাতব্বরের ভূমিকায় থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করাই যেন তাদের রীতি। এরই ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে ওয়াশিংটন যে তৎপরতা দেখাচ্ছে সেদিকেই হাঁটছে ইইউ।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রমনীতি ঘোষণার পরপরই দেশের তৈরি পোশাকের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নানা ধরনের চাপ আসছে বলে জানিয়েছে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক’ উল্লেখ করে সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে জড়িত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দুই সদস্য। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং রাষ্ট্রদূত তৌহিদ হোসেনের মতে, এই অঞ্চলে পশ্চিমা বিশ্বের নীতি সুনির্দিষ্ট হয়েছে কি না সেটা নিশ্চিত হতে হলে দেশের জাতীয় নির্বাচনের পরে অন্তত ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। তারা যে ধরনের থ্রেট করছে, সে অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হলে বুঝতে হবে কোনো সমঝোতা হয়েছে।
ঢাকা-নয়াদিল্লি: দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশ-ভারত দুই পক্ষ থেকেই বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে বলে দাবি করা হয়। লক্ষ্য করা যায় শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক যোগাযোগ। বিশ্লেষকদের মতে, এক্ষেত্রে লাভের পাল্লা সবচেয়ে বেশি ভারী ভারতের। ভারত বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে সাধারণ ভোটার ও বিশ্লেষকদের, তারা বলেন, ভারত তাদের নিজেদের লাভের জন্য বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারকে বারবার সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, মানুষ ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ভারত যা চেয়েছে সবকিছু উজার করে দিয়েছি। আর ভারত সবকিছু বাংলাদেশ থেকে পাওয়ার পরও বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করেনি। তবে ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের সবচেয়ে সমালোচিত এবং অমীমাংসিত বিষয় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা। মূলত তিস্তার পানি আটকে রাখায় দুর্ভোগ থেকে আজও মুক্তি পায়নি দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ। দুই বন্ধু দেশের সীমান্তে অবৈধ চলাচলকে কেন্দ্র করে হত্যার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। সীমান্ত হত্যা বিষয়ে দুই পক্ষ থেকেই বারবার ‘জিরো টলারেন্সে’র কথা বলা হলেও থামছে না সীমান্ত হত্যা। ঢাকা-নয়াদিল্লি থেকে মারণাস্ত্র অস্ত্র ব্যবহার না করার নির্দেশনা থাকলেও মানছে না ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
এদিকে গত ২৪ নবেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের অঙ্গীকারে আস্থা রেখেছে ভারত।’ সেসময় নয়াদিল্লিতে অবস্থান করা বিভিন্ন মিশনের ৫০ জনের অধিক রাষ্ট্রদূতকে দেশের নির্বাচন পরিস্থিতি ব্যাখা করেছেন এই কূটনীতিক। ভোটের আগে পররাষ্ট্রসচিবের এই দিল্লি সফর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠে বিভিন্ন মহল। ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত নতজানু বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান। ভারতের কারণেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে বাংলাদেশ ব্যর্থ বলেও জানান এই বিশ্লেষক।
ঢাকা-নেপিদো (মিয়ানমার) এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর গণহত্যার মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পুরো সেপ্টেম্বরেই লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঢল নামে বাংলাদেশে। এর আগে বিভিন্ন সময়েও সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও নিপীড়িত এত মানুষের ঢল দেখা যায়নি। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জীবন বাঁচানোর কারণে স্বাভাবিকভাবেই গোটা বিশ্বের নজর কাড়ে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের নানা বৈঠকে উঠে আসে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। গত ৬ বছরে দফায় দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয় ঢাকা-নেপিদো। তবে মিয়ানমারে সেনা শাসন ও অস্থিরতার জেরে একবারও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি। একসময় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা গেলেও গেল শেষ বছরে প্রত্যাবাসন কূটনীতিতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অন্যদিকে মানবপাচার, হত্যাকা- থেকে শুরু করে অপরাধমূলক নানা ধরনের কর্মকা- ঘিরে কক্সবাজার আশ্রয় শিবিরে অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে গত বছর বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীনের ত্রিপক্ষীয় কমিটির কোনো অগ্রগতিও লক্ষ্য করা যায়নি।
ঢাকা-বেইজিং: বর্তমানে বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অংশীদার দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ চীন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অর্থনীতি যত বড় হবে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ঢাকা-বেইজিং বাণিজ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশই আসে বেইজিং থেকে। যদিও মোট রপ্তানির মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ যায় দেশটিতে।
এছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বি আরআই) আওতায় এরই মধ্যে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য তাদের। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম বি আরআইতে যোগ দেয়। বাংলাদেশকে ঘিরে আঞ্চলিক যোগাযোগ সৃষ্টিতে চীনের তৎপরতা রয়েছে যা লক্ষণীয়। সম্প্রতি ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, নির্বাচনের পর ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। এবারের নির্বাচনে বর্তমান সরকারের পক্ষে একরকম সমর্থন জানাচ্ছে চীন। এছাড়া বিগত কয়েক মাসে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশের আলোচনার মাঝে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের নির্বাচনকে সমর্থন করে চীন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন করতে সক্ষম বলেও মনে করে পরাশক্তিধর দেশটি।
ঢাকা-মস্কো: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতেই রাশিয়া বাংলাদেশকেও টার্গেট করেছে বলেই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এইবারই প্রথম বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে মার্কিন চাপের কঠোর সমালোচনাও করছে রাশিয়া। লক্ষ্য করা যায়, এই অঞ্চলে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বাংলাদেশেই। প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে করা হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিভিন্ন সরঞ্জাম পাবনায় পাঠাতে বেগ পেতে হচ্ছে রাশিয়াকে।
এদিকে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী রাশিয়া। সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে, যা প্রশংসনীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এক প্রশ্নের উত্তরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করি, তাহলে দেখব ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের নামে তাদের লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা, যা কার্যত বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ।’
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, রুশ জাহাজ চলাচলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঠিকঠাক সরঞ্জাম পাঠাতে পাচ্ছে না রাশিয়া। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে পারলে ক্ষতির মুখে পড়বে তারা। এটা তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে চক্রের মধ্যে রয়েছি সেটা অবশ্যই ক্ষতিকর একটি দিক। তাদের মতে, বিএনপি অংশ না নিলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, নির্বাচনী পরিবেশ, আচরণবিধি অনুসরণসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছেন পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। নির্বাচন পর্যন্ত তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে এমন বিব্রতকর অবস্থা এড়াতে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, গত ২২ নবেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকারবিরোধী দলের সঙ্গে পরিকল্পনায় যুক্ত আছেন। দেশটির এমন মন্তব্যে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। পুনরায় ১৫ ডিসেম্বর রুশ মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা অভিযোগ তুলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের পর ‘আরব বসন্তের’ মতো বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এমন বাস্তবতায় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য সমর্থন করে না ঢাকা। এ থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।