পাঠ বইয়ে ব্যাপক ভূল থাকায় সাতক্ষীরায় বিতরণকৃত বই ফেরত নেওয়া হচ্ছে

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরা:  ভুলে ভরা  থাকায় বিতরণকৃত পাঠ্য বই ফেরত নেওয়া হচ্ছে। ইসলাম সম্পকে বিতকিত সব লেখা থাকায় তোপের মুখে সাতক্ষীরায় ১ হাজার ৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের থেকে ইসলাম ধর্মের সকল বই ফেরত নিচ্ছে সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। সোমবার (১ জানুয়ারি) বই উৎসবের পরপরই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণকৃত ওই পাঠ্যবই ফেরত নেয়ার জন্য স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেন উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক কর্মকর্তারা। এরপর থেকে ওই পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের থেকে ফেরত নেওয়া শুরু করেন ওইসমস্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। তবে কেন ও কিসের জন্য এই পাঠ্যবই ফেরত নেয়া হচ্ছে সেব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নন কেউ।

এবার প্রাথমিক স্তরে ২য় শ্রেণি আর মাধ্যমিকে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামে বই দেওয়া হয়েছে। এসব বইয়ে নানা ভুলভ্রান্তি, বাক্য গঠনে অসঙ্গতির তথ্য পাওয়া গেছে।আবার অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলোকে তুলে ধরা হয়েছে খুবই ‘খোলামেলা’ ভাষায়। যেখানে আপত্তিকর অনেক শব্দ রয়েছে। যা নিয়ে চরম আপত্তি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা।সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর থেকে নতুন কারিকুলামে বই দেওয়া শুরু হয়। ওই বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুল-ভ্রান্তির সত্যতা পায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ভুলগুলো সংশোধন করে এপ্রিল মাসে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সংশোধনী দেওয়া হয়। শিক্ষকরা সংশোধিত সিলেবাসে বাকি বছর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। তড়িঘড়ি করে নতুন কারিকুলাম চালুর কারণে এমনটি হয়েছে বলে দাবি করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

সরেজমিনে মঙ্গলবার সাতক্ষীরা শহরের টাউন সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেয়ে দেখা যায়, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ওই বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মের সকল বই জমা দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। যারা আসতে কিংবা বই জমা দিতে দেরি করছে তাদেরকে মুঠোফোনে দ্রত বই জমা দেয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন দায়িত্বরা শিক্ষা কর্মকর্তারা।
বই জমা দিতে আসা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা করার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বই বিতরণের পর স্ব স্ব ক্লাসটারের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা আমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর বিতরণকৃত ইসলাম ধর্মের সকল বই মঙ্গলবার ১১টার ভিতরে ফেরত দেয়ার জন্য বলেন। এজন্য আমরা তাৎক্ষণিকভাবে থেকে বই ফেরত নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি। অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে না আসলেও আমরা শিক্ষকরা তাদের বাসাতে যেয়ে বই সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছি। তবে কেন বা কিসের জন্য এই বই ফেরত নেওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে কোন কিছু জানেননা বলে দাবি করেন তারা।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র, নজরুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা কাজ করছি। কোন কিছু জানার থাকলে তাদের কাছে শুনতে পারেন। এ ব্যাপারে আমরা কেউ কোন কিছু জানিনা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ভিতরে ইসলাম ধর্মের ৮হাজার ১৫০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা সকাল থেকে শিক্ষকদের থেকে বই সংগ্রহ করছি। পরবর্তীতে তারা যে নির্দেশনা দেবেন আমরা সেটা পালন করবো।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম ভুইয়া চৌধুরী বলেন, প্রিন্টিং মিসটেকের কারনে বইগুলো তুলে নেয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) হোসনে ইসায়মিন করিমী বলেন, সাতক্ষীরার সকল উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম ধর্মের সকল বই শিক্ষার্থীদের থেকে ফেরত নেওয়া হচ্ছে। বইতে কোন প্রকার ভুল আছে কিনা সেটা দেখার জন্য।
শুধুমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর ইসলাম ধর্মের পাঠ্য বই কেন ফেরত নেওয়া হচ্ছে? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনকিছু বলা সম্ভব না। বিষয়টা আমরা আপনাদের পরে ক্লিয়ার করতে পারবো।

যেসব ভুল পাওয়া গেছে

এবার সপ্তম ও ৮ম শ্রেণিতে নতুন কারিকুলামের বই দেওয়া হয়েছে। এসব বইয়ে বড় ধরনের ভুল না পেলেও বানান, বাক্য গঠনে অসঙ্গতির মতো বিষয় পাওয়া গেছে। যদিও নতুন বইগুলোতে লেখা হয়েছে— ‘বাংলা একাডেমির যে বানান নীতি রয়েছে তা অনুসরণ করে’।

নবম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ভূমিকায় সহযোগিতা বানান লেখা হয়েছে সহযোগীতা। এখানে ‘‘ি’’-এর স্থলে ‘‘ ী’’ ব্যবহার করা হয়েছে।

একইভাবে এই বইয়ের ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান মানা হয়নি। যেমন ‘ভাতখণ্ড’ কে লেখা হয়েছে ‘ভাতখন্ড’।

পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়— বাক্যটি এই বইয়ে ১৫ বার ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ বার ‘পৃখিবী’ লেখা হয়েছে। এখানে ‘থ’ স্থলে ‘খ’ অক্ষর লেখা হয়েছে। আরেক জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিকের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানিক, পাকিস্তানকে লেখা হয়েছে পকিস্তান।

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে সুস্থ বানান লেখা হয়েছে সুস্থ্য‌। ‘য’ ফলা ব্যবহার করা হয়েছে, যা ভুল। এ ছাড়া বাক্য গঠনেও অনেক ভুল ও অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের পাণ্ডুলিপি তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। এজন্য কিছু ভুল থাকতে পারে। ভুলগুলো চিহ্নিত করার পর সংশোধন করে আগামীতে আবার বই ছাপানো হবে। বড় ধরনের কোনো ভুল পাওয়া গেলে তা কারেকশন আকারে শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারা সেই মোতাবেক শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাবেন।

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে আপত্তিকর অধ্যায়

অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ‘কৈশোরের কথামালা’ অধ্যায়ে ১৬টি পৃষ্ঠা রয়েছে। প্রত্যেক পৃষ্ঠায় কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো খোলামেলাভাবে আলোচনা করা হয়েছে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের নির্দিষ্ট বয়সের পর তাদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো কীভাবে হয় তা গল্প দিয়ে বোঝানো হয়েছে। গল্পের পর তাদের কুইজ-উত্তর লেখার অপশন রাখা হয়েছে।

শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরিবর্তনের এ বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোকে স্বাগত জানালেও যে ভাষায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা বলছেন, এই অধ্যায়টা কিশোর-কিশোরীদের বয়স উপযোগী হয়নি। এমনকি যেসব ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা আমাদের দেশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে যায় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষা দেব, এটা যেমন ঠিক তেমনি সেটা যেন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট, পরিবেশ পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে হয় সেটাও দেখা উচিত। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির বইয়ের একটি অধ্যায়ে বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা খুবই দৃষ্টিকটু ও আপত্তিকর।’

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।