সামছুল আরেফীন
শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের নামে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বছরজুড়ে চলেছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। শেষদিকে এসে তা গড়িয়েছে আন্দোলনে। নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক-শিক্ষকও। শিক্ষাক্রম নিয়ে তুমুল বিতর্কের বছরে ছিল নানান ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের উত্তাপও। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে টানা ২৩ দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন করেন শিক্ষকরা। এতে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব বেসরকারি স্কুল-কলেজের ক্লাস-পরীক্ষা।
২০২৩ থেকে শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে তা শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতানির্ভর পড়াশোনায় জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বদলে গেছে চিরাচরিত পড়াশোনার পদ্ধতিও। তবে শিক্ষাক্রমের এমন আমূল পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। এক পক্ষ বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী। একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ, যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এটি সহায়ক। অন্য পক্ষ শিক্ষাক্রমের কড়া সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমে ইসলাম বিরোধী চিন্তা ধারা সংযোজন করা হয়েছে বলে দাবি উঠে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন অভিভাবকরা। তবে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানোর অভিযোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হয়। এতে এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা বর্তমানে কারাগারে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী। তবে বর্তমান বাস্তবতায় তা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব, শিক্ষার্থীর চাপ, দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা-সহায়ক উপকরণের সংকট, মানসম্মত প্রশিক্ষণ ও প্রথাগত মনোভাব।
২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। সরকার সেই আন্দোলনে গুরুত্ব দেয়নি। কোনো ধরনের আশ্বাস ছাড়াই গুটিয়ে যায় আন্দোলন। ২০২৩ সালে আবারও জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা একই দাবিতে আন্দোলনে নামেন।
১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষকরা। এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সভাপতি অধ্যক্ষ বজলুর রহমান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ। টানা ২৩ দিন অবস্থান কর্মসূচি ও অনশন করেন তারা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি জানিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যান আন্দোলনকারীরা। ১ আগস্ট রাতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে অনশন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরেন।
তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জাতীয়করণ দাবি পূরণে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়নি সরকার। এ নিয়ে দু’টি কমিটি করে দিলেও বিষয়টি এখন ‘চাপা পড়ে গেছে’। ফলে এবারের আন্দোলনও বৃথা বলে মনে করছেন শিক্ষকরা। উল্টো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষকরা সরকারের রোষানলে পড়েছেন বলে অভিযোগ শিক্ষক নেতাদের। বিপাকে পড়াদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ। নিজ স্কুল থেকে দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কাওছার আহমেদ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে ফাঁসানোর অভিযোগ করেছেন।
২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। ২৮ জুলাই এসএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা গেছে, ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন। নিম্নমুখী এ ফলাফলে শিক্ষাবিদরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার পর পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেওয়ায় ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে। তবে এটি অস্বাভাবিক নয়।
নির্বাচনের বছর হওয়ায় এবার দুই মাস আগে পাঠ্যবই ছাপানো শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে লেজেগোবরে অবস্থায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নতুন শিক্ষাক্রমে বইয়ের পা-ুলিপি প্রস্তুতে দেরি, টেন্ডারে অনিয়মসহ নানান কারণে এখনো সব বই ছাপানো সম্ভব হয়নি। এরপরও আজ ১ জানুয়ারিই বই উৎসব করবে সরকার। বছরের প্রথম দিনে কিছু বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়ে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কৌশলে এগোচ্ছে এনসিটিবি। তবে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বিশেষ করে ৮ম ও ৯ম শ্রেণির কিছু বই বছরের একেবারে শেষ দিকে প্রেসে দেয়া হয়েছে। সেই বইগুলো আর বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছবে না।
এদিকে আন্তক্যাডার-বৈষম্য নিরসন ও সুপারনিউমারারি পদ (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত পদ) সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে গত অক্টোবরে কর্মবিরতিতে নামেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। পরে আন্দোলনকারী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলন স্থগিত করেন। এখন পর্যন্ত মূল দাবি পূরণ হয়নি। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা আশা করছেন, হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল দাবির একটি পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে।
তবে লটারির মাধ্যমে বিদ্যালয়ের ভর্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেছে। বিদায়ী বছরের মতো আসন্ন শিক্ষাবর্ষেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদ্যালয়গুলোতে লটারিতে শিক্ষার্থী ভর্তির বাছাই হয়েছে। লটারিতে ভর্তির ফলে একদিকে ভর্তির পরীক্ষা নিয়ে ‘মাতামাতি’ বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে ভালো বিদ্যালয়ে কেবল ‘ভালো শিক্ষার্থীরাই’ ভর্তি হওয়ার সুযোগ কমেছে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা’ জারি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী- কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি যেসব স্কুল রয়েছে, তা সবই ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে অভিহিত হবে। স্কুলে পাঠদান শুরু করতে অনুমতিপত্র লাগবে। অনুমতি পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই যথাযথ নিয়ম মেনে নিবন্ধন করতে হবে।
বিধিমালায় স্কুলের প্রাথমিক অনুমোদন, নিবন্ধন, নবায়ন, শিক্ষক নিয়োগ, ভবনের জমির আয়তন, তহবিল গঠন ও পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। প্রায় ১০ বছর ধরে চেষ্টার পর ২০২৩ সালে এ নীতিমালা করা সম্ভব হয়েছে।