নাছির উদ্দিন শোয়েব
কালের নিয়মে বিদায় নিয়েছে আরও একটি বছর। বিগত ২০২৩ সালের শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শেষের দিকে। সদ্য সমাপ্ত বছরের মাঝামাঝি রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশকে ঘিরে সহিংস হয়ে ওঠে রাজপথ। বাড়তে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীেেদর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল বিরোধী নেতাদের হয়রানি করার। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের ওপর হামলা ও গুমের অভিযোগও আছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড ও সাজা দেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ে বছরের শেষের দিকে। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ডাকা হারতাল-অবরোধে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের ঘটনায় তৎপরা আরও বেড়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মারমুখি কর্মকা-ে সাধারণ মানুষ চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় ছিল বছরটিতে।
বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গত ৬ মাসে দলের ২৬ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ১০৮৪টি। এ সব মামলায় আসামী করা হয়েছে ৯৭৩৪৬ জনকে। এ ছাড়া গত ৫ মাসে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে ৯৭ মামলায় ১ হাজার ৫৩২ জনের সাজা হয়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন হামলা ও কারাবরণে দলের ২৬ নেতাকর্মী মারা যান। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘একতরফা’ তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ১১ হাজার ৪৪৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় মামলা হয়েছে ৪১৩টি। এসব মামলায় ৪৪ হাজার ৬৬৮ নেতাকর্মীকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন হামলা ও কারাগারে দলের ১৩ নেতাকর্মী মারা যান। রিজভীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ ও ২৯ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে দলটির ২৬ হাজার ৪৪১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময়ে ১০৮৪টির বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সব মামলায় ৯৭ হাজার ৩৪৬ নেতাকর্মীকে আসামী করা হয়েছে। আর এই ৫ মাসে বিভিন্ন হামলা ও কারাগারে এক সাংবাদিকসহ দলের ২৬ নেতাকর্মী মারা গেছেন। ৮১টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদ- এবং ১ হাজার ২৬৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আলতাফ হোসেন, মোহাম্মদ শাহজাহানসহ শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে রয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশে সরব হওয়ায় হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার হচ্ছেন বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কয়েক মাস ধরে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপি’র অসংখ্য নেতাকর্মী হামলার শিকার হন। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগকেই দুষছে বিএনপি। বছরের মাঝামাঝি দলটির বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরেও দেশের বিভিন্ন জেলায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিকে হামলা, মামলা ও সংঘর্ষের মধ্যেই সরকার বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র করতে চাইছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপি’র আন্দোলন বানচাল করতে সরকার হামলা, মামলার নামে সহিংসতা চালাচ্ছে। সরকার নিজেরাই দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। প্রতিনিয়তই বিএনপি’র নেতাকর্মীদের দমন করতে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সরকারে এসব সহিংসতা উপেক্ষা করে দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে। বিএনপি’র সভা-সমাবেশে জনস্রোত সৃষ্টি হয়েছে। এ সব দেখে সরকার ভীত হয়ে পড়েছে। এজন্য আওয়ামী লীগ পথে পথে নেতাকর্মীদের বাধা দিচ্ছেন। হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে আবার তারাই মামলা দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করাচ্ছেন।
মানবাধিকার পরিস্থিতি: বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ২০ জন। এর মধ্যে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারে সাজেদুল ইসলাম মান্না এবং নারায়ণগঞ্জে র্যাবের গুলীতে আবুল কাশেম নিহত হন। এছাড়া পুলিশের হেফাজতে ১৩, র্যাবের হেফাজতে দু’জন ও ডিবি (গোয়েন্দা) পুলিশের হেফাজতে তিনজন নাগরিকের মৃত্যু হয়। এসব তথ্য তুলে ধরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক জানায়, এসব হত্যাকা-ের অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। এর আগে ২০২২ সালে ১৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিলেন। আসকের তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ নানা কারণে মারা গেছেন ১০৫ জন। এরমধ্যে কয়েদি ৪২ এবং হাজতি ৬৩ জন। এর আগে ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা যান ৬৫ জন। এরমধ্যে কয়েদি ২৮ এবং হাজতি ৩৭ জন। আইন ও সালিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ৯ জন। এরমধ্যে পরবর্তী সময়ে ছয়জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরবর্তীতে ফিরে এসেছেন তিনজন, যা গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে।
আসক জানায়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটকের ঘটনা ঘটছে। পরিবার ও স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার বা আটকের তথ্য না দিয়ে সরাসরি নাকচ করে দেওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এরপর বিভিন্ন অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখিয়েছে। আটক এবং গ্রেফতার দেখানোর সময়কালের মধ্যে যে ফারাক তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা লক্ষ্য করছি না। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট ব্যত্যয় লক্ষ্য করা গেছে। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাব মতে, ২০২৩ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক ৩০ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে লালমনিরহাটে ৩, সুনামগঞ্জে ১, ঝিনাইদহে ১, দিনাজপুরে ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩, চুয়াডাঙ্গায় ৫, পঞ্চগড়ে ৫, কুড়িগ্রামে ১, ঠাকুরগাঁয়ে ৪, সিলেটে ১, মৌলভীবাজারে ১ ও রাজশাহীতে ৩ জন নিহত হন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ কর্তৃক ৩১ জন নাগরিক মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০২২ সালে বিএসএফ কর্তৃক নিহত হন ২৩ জন বাংলাদেশী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১ জন। ২০২২ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৩৬ জন।
শীর্ষ নেতাদের সাজা: জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন, বিগত দুই সপ্তাহে ৭৯ মামলায় এক হাজার ২৩৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর পরবর্তী তিন কার্যদিবসে আরও অন্তত ১৭৯ বিএনপি নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে। এসব রায়ে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ মো. শাজাহান, কুষ্টিয়া-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আহসান হাবিব লিংকন, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরপত আলী সপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, যুবদলের বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সেক্রেটারি রাজিব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সেক্রেটারি আকরামুল হাসান মিন্টু, হাবিবুর রশিদ হাবিব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু প্রমুখ। এর মধ্যে সোহেল, টুকু, নীরবসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় কারাদ- হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। তাদের অনেককেই প্রতিদিন আদালতে যেতে হয়েছে। আদালতের বারান্দায় তাদের ঠিকানায় পরিণত হয়। তাদের একজন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান। তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা সাড়ে চারশর বেশি। হাবিব উন নবীর ৫০টিরও অধিক মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সাড়ে চার শ মামলার আসামী হাবিব উন নবী খান প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে যান। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ৫০টির অধিক রাজনৈতিক মামলা সচল; তার প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলার শুনানির দিন ধার্য থাকে। এসব মামলায় আগে এক-দুই মাস, তিন মাস পর শুনানির দিন ধার্য থাকত। দুই মাসের বেশি সময় ধরে শুনানির দিন ধার্য হচ্ছে ৭ থেকে ১৫ দিন পরপর। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশি মামলা রয়েছে। তাকেও প্রায়দিনই আদালতে যেতে হয়েছে ২০২৩ সালে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের একটি মামলায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম নিরবসহ আটজনের তিন বছরের কারাদ-ের আদেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম পৃথক দুই ধারায় এ কারাদ-ের আদেশ দেন। কারাদণ্ড প্রাপ্ত অন্য আসামীরা হলেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভুইয়া জুয়েল, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, বিএনপির হারুন অর রশিদ, ওবায়দুল হক, শহীদুল ইসলাম হীরা ও ইব্রাহীম।
গতকাল রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম পৃথক দুই ধারায় এ কারাদণ্ডের আদেশ দেন। দণ্ডবিধি ১৪৭ ধারায় এক বছর ও ৪৩৫ ধারায় দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেন আদালত। জরিমানা অনাদায়ে তাদের আরো দুই মাসের কারাভোগ করতে হবে।