পাশাপাশি ছোট তিনটি গ্রাম—হাটচালা, দেওল ও শংকরকাটি। গ্রামগুলোর বুক চিরে বয়ে গেছে নোনাপানির প্রবাহ—চুনা খাল। লবণাক্ততার কারণে গ্রামগুলোতে একটির বেশি ফসল হতো না। একসময়ের অনুর্বর সেসব ফসলি জমিতে স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের দিন আমূল বদলে ফেলেছেন। নিরলস শ্রম দিয়ে উপকূলের চাষিরা সবজির ‘সবুজ বিপ্লব’ ঘটিয়ে দেখিয়েছেন। গ্রামগুলোতে এখন বছরজুড়ে ফসল ফলে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হাটচালা গ্রামের মনোতোষ মণ্ডলের (৬০) হাত ধরে এই সবজি বিপ্লবের শুরু। মনোতোষের দেখানো পথ ধরে এই তিন গ্রামের কৃষকেরা বছরে এখন কয়েক কোটি টাকার সবজি উৎপাদন করছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর তাঁদের চাষ করা সবজি যাচ্ছে অন্য জেলাতেও।
হাটচালাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে সবজি চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। এসব এলাকার কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। আর এসব সম্ভব হয়েছে মনোতোষ মণ্ডলের উদ্যোগে। তিনি সবাইকে পথ দেখিয়েছেন।
এ কে এম জাফরুল আলম, স্থানীয় ভরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান
মনোতোষের হাত ধরে
গ্রামে গ্রামে ফেরি করে শাঁখা বিক্রি করতেন মনোতোষ মণ্ডল। সংসারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ দশা। কীভাবে একটু ভালো থাকা যায়, সে চিন্তা থেকে পেশার পরিবর্তন করে শাকসবজি চাষে ঝুঁকলেন তিনি। সেটি বছর ৩০ আগের কথা। মনোতোষ মণ্ডল তাঁর বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ শুরু করলেন। তিনি দেড় বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেন। তাতে তেমন লাভ না হলেও সংসার চলত কোনো রকমে।
তখন অনেকটা না বুঝে চাষ করতেন। পরে কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নেন। সঙ্গে নিজের জ্ঞানও কাজে লাগান। মনোতোষ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ শুরু করেন ২০১৪ সাল থেকে। এক জমিতেই বছরজুড়ে নানা ধরনের শাকসবজির উৎপাদন হতে থাকে। তিনি এখন আড়াই বিঘা জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, উচ্ছে, টমেটো, বেগুন, কাঁচা মরিচসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করেন। বছরে খরচ বাদ দিয়ে ছয়-সাত লাখ টাকা তাঁর আয় হয়।
মনোতোষের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় বাজার ও পদ্মা নদীর এপারের খুলনা, যশোর ও বরিশালে পাঠানো শুরু হয়। তখন থেকে তাঁর দিনবদল শুরু। তাঁর সাফল্য দেখে ও তাঁর সহযোগিতায় গ্রামের অনেকেই সবজি চাষ শুরু করেন। এখানকার কৃষকেরা কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই সবজি চাষ করেন বলে জানান মনোতোষ মণ্ডল।
সাফল্য পেয়েছেন অনেকে
মনোতোষের সবজি চাষের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন পাশের দেওল গ্রামের অক্ষয় কুমার মণ্ডল। পৈতৃকভাবে ২৫ শতাংশ জমি পেয়েছেন তিনি। চাষাবাদ আর দিনমজুরি করে চলত তাঁর সংসার। নিজের জমির পাশ দিয়ে চুনা খাল যাওয়ায়, আগে বছরে তিনি একটি ফসল ফলাতেন। বছর দশেক আগে ৭ শতাংশ জমিতে একটি পুকুর খনন করে সেখানে মিঠাপানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিনি। বাকি ১৮ শতাংশে করোলা, ঢ্যাঁড়স, কপিসহ কাঁচা মরিচের চাষ শুরু করেন। এভাবে কয়েক বছর যেতে না যেতেই সচ্ছলতার মুখ দেখেন মনোতোষ।
অক্ষয় কুমার জানান, মাত্র ২৫ শতাংশ জমির ওপর ভর করে পরবর্তী সময়ে তিনি পাশের আরও ১৬ শতাংশ জমি কিনে সেখানেও সবজির চাষ শুরু করেন তিনি। ৮-১০ বছরের ব্যবধানে দেড় লাখ টাকা খরচ করে গোয়ালঘর তৈরি, চারটি গরু কেনা ছাড়াও পাকা ঘর নির্মাণ, সার–কীটনাশকের দোকান দেওয়ার পাশাপাশি দুই সন্তানকে কলেজ ও বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন অক্ষয়।
পদ্ম সেতু চালু হওয়ায় গ্রাম তিনটির সবজিচাষিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর তাঁদের সবজি সরাসরি প্রতিদিন যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে।
প্রায় একই রকম সাফল্যের গল্প শোনান হাটচালা গ্রামের জগবন্ধু মণ্ডল। তিনি বলেন, তাঁরা তিন ভাই সারা বছর একই জমিতে একে একে কপি, বেগুন, উচ্ছে, করোলা, মিষ্টিকুমড়া ও কাঁচা মরিচের চাষ করেছেন। একপর্যায়ে আরও দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে সবজি ফলিয়ে এখন তাঁরা স্বাবলম্বী।
সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা
সবজি চাষের জন্য প্রচুর মিঠাপানি সেচের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ তিন গ্রামে ভূগর্ভের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। মিঠাপানির আধার পুকুরও কম। তবে সবজি চাষ লাভবান হওয়ায় কিছু মানুষ নিজের জমিতে ছোট ছোট পুকুর খনন করে সেচের অভাব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন।
দেওল গ্রামের কমলেশ মণ্ডল জানান, তাঁদের ছোট দুটি পুকুরের পানি দিয়ে সবজি চাষ করেন। গরমের শুরু থেকে পানিসংকট প্রকট হয়। তখন পাশের সোতা গ্রাম থেকে কিছু মানুষ পাইপ দিয়ে পানি টেনে এনে সবজি চাষ করেন।
দেওল গ্রামের সফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে এখন তাঁদের সবজি যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় গ্রামগুলোতে সরাসরি ট্রাক ঢুকতে পারছে না। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে তাঁরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তবে পদ্ম সেতু চালু হওয়ায় গ্রাম তিনটির সবজিচাষিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর তাঁদের সবজি সরাসরি প্রতিদিন যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে।
সহায়তার আশ্বাস
স্থানীয় ভরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাফরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাটচালাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে সবজি চাষে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। এসব এলাকার কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। আর এসব সম্ভব হয়েছে মনোতোষ মণ্ডলের উদ্যোগে। তিনি সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। তবে পানির সমস্যা দূর করতে পারলে কৃষকেরা সবজির আরও ভালো ফলন পেতেন।
পানির সমস্যা সমাধানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখবেন বলে জানান শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, এই তিন গ্রামের ১৫০ হেক্টর জমি থেকে বছরে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হচ্ছে। হাটচালা গ্রাম থেকে বছরে ২২০০-২৩০০ মেট্রিক টন, দেওল ও শংকরকাটি থেকে ২৭০০-৩০০০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়। যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। প্রথম আলো