সাতক্ষীরায় তিনমাসে ৩টি হত্যাকান্ডসহ ৬৮জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু

সাতক্ষীরা ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন প্রকাশ

আসাদুজ্জামান সরদার: সাতক্ষীরায় মানবাধিকারের ক্ষেত্রে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে এবং অপরাধ প্রবণতা কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর এইচআরডি নেটওয়ার্ক সদস্যরা। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর এইচআরডি নেটওয়ার্কের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত তিন মাসে জেলায় ৩টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ৯জনের আত্মহত্যাসহ অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ৬৮জনের। বিভিন্ন অপরাধে ৫১৩টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ও জিআরও অফিস সূত্রে এ রির্পোট প্রস্তুত করা হয়।
প্রতিবেদনে জানা গেছে, জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা ১৪জন, আত্মহত্যা ৯, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৪ জন, পানিতে ডুবে ৩, সাপের কামড়ে ১ এবং জেলখানায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছে ১জন। পুলিশ ৫জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। এছাড়া তিন মাসে দুই শিশুসহ ৭টি ধর্ষণ ও ৩টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসময় পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১৮টি মামলা করেছে।
সাতক্ষীরায় মানবাধিকার পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়ে জেলা পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি সভায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় শহরের ম্যানগ্রোও সভা কক্ষে ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) সহায়তায় উত্তরণ-ডিএইচআরএনএস প্রকল্পের আওতায় গঠিত ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক সাতক্ষীরার আয়োজনে অনুষ্ঠিত সভায় ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক সাতক্ষীরা শাখার আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর সমন্বয়কারী মো: টিপু সুলতান, ডিস্ট্রিক্ট হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক এর সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল হামিদ, প্রফেসর ড. দিলারা বেগম, জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক এড: আজাদ হোসেন বেলাল, জেলা তথ্য অফিসার জাহারুল ইসলাম, এমএসএফ এর যুগ্ম আহ্বায়ক মানবাধিকারকর্মী মধব চন্দ্র দত্ত, এড: শাহনেওয়াজ পারভীন মিলি, এড: নাজমুন নাহার ঝুমুর, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, নিজ অধিকারের পরিচালক ড. দিলীপ কুমার দেব, সাংবাদিক মিজানুর রহমান, এড: আসাদুজ্জামান দিলু, জেলা মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জ্যোৎ¯œা দত্ত, জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী, উদিচির শেখ সিদ্দিকুর রহমান, জেলা নাগরিক কমিটির আলিনুর খান বাবুল, সিডোর নির্বাহী পরিচালক শ্যামল বিশ্বাস, সাংবাদিক আব্দুস সামাদ, এইচআরডি নেটওয়ার্কের এড খায়রুল বদিউজ্জামান, এড: ফরিদা আক্তার বিউটি, দলিত পরিষদের গৌর পদ দাস প্রমুখ।

সভায় বক্তারা বলেন, বিগত কয়েক মাসে জেলায় ধর্ষণের অভিযোগে ৬০জনের উপরে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য সদর হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র ৬টি। অনেকে মৌলিক অধিকার এবং মানবাধিকার একই করে ফেলেন। মাদক মামলা কতটি হচ্ছে সেটা খেলায় রাখতে হবে। কক্সবাজারে থেকে ইয়াবা চলে আসছে। আমাদের চিন্তার বিষয়। জেলখানায় যা খেতে দেওয়ার কথা তা খেতে দেওয়া হয় না। তারা সংশোধন না করে আরও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালে যা খেতে দেওয়ার কথা তাদের খেতে দেওয়া হয় না। রোগীরা বিপদে রয়েছে।
আইন সহায়তা দিয়ে আসছে জেল লিগ্যালএইড। এই সম্পর্কে জানলে বিনাখরচে আইনী সহায়তা পাবেন। সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করলে। নারী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরষ নির্যাতন। এটার জন্য আইন পাশ হওয়া দরকার। ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ভূমিহীনদের জায়গা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অনেকে যৌননির্যাতেন শিকার হয়েও মামলা করতে ভয় পাচ্ছে।
বক্তারা আরও বলেন, অনেক সময় অধিকার, মানবাধিকার এবং আইনী অধিকার আমরা এক করে ফেলি। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে সবাই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারবে। সড়ক দুর্ঘটনা নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ১মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দাবী করতে হবে। মৃত্যুবরধকারীকে ৫লাখ টাকা এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ৩লাখ টাকা অনেকে জানেনা। সেকারণে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। ক্ষতিপূরণ দেওয়া সংক্রান্ত বোর্ড আছে। সেই বোর্ডের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। পুলিশ ধরে এনে যে আইনে মামলা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু হয়ে অন্য মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে।
হাসপাতালগুলোতে কত সময় চিকিৎসকরা থাকেন? রোগীদের ওষুধ দিচ্ছে না। জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার বাড়ি থাকলে জেলায় ভিক্ষুকের সংখ্যা কত বোঝা যায়। তাদের জায়গা জমি কেড়ে নিলে সেটা দেখতে হবে। জেলা কত হাজার ভূমিহীন আছে, কত বেকার আছে আমাদের খোঁজ নিতে হবে। মানাবধিকার লঙ্ঘন করেন ক্ষমতাশালীরা। এর বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, নতুন প্রজন্ম বিপথে চলে যাচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে হবে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন। এসএসএফের কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিতে যুব সংগঠনের যুক্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে এমএসএফ সম্পর্কে জানাতে হবে। সালিশীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার কারণে অনেক অপরাধী প্রকৃত আইনের সাজা থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। মানাবাধিকার ও আইনী অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। ব্যক্তির দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। আমরা নিজেরা অন্যের মানবাধিকার লঙ্ঘন না করি-সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি ভরে গেছে। সবাইকে সচেতন করতে হবে। আইন জানাতে হবে এবং মানাতে হবে। সচেতনতাই পারে মানবাধিকার লঙ্ঘন কমাতে। মানবাধির লঙ্ঘন হ্রাস করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ফাউন্ডেশন থেকে বলা হয়, ডিসেম্বর মাসে জেলায় খুন হয় ১জন। এমাসে পুলিশ আত্মহত্যা সন্দেহে ২টি মরদেহ উদ্ধার করে। সড়কে ৩জন, বিদ্যুত স্পৃষ্টে ১, পুলিশ কর্তৃক মরদেহ উদ্ধার ২, ধর্ষণের অভিযোগ ৪, অপহরণ ২, সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ মাসে পুলিশ ১৮টি ককটেল উদ্ধার করে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বর মাসে পুলিশ আত্মহত্যা সন্দেহে ২জনের মরদেহ উদ্ধার করে। এ মাসে পানিতে ডুবে ১জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ২জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ২জন এবং সাপের কামড়ে ১জনের মৃত্যু হয়। এমাসে অপমৃত্যু সন্দেহে আরও তিনটি মরদেহ উদ্ধার করে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জেলায় খুন হয় ২জন। এ মাসে পুলিশ আত্মহত্যা সন্দেহে ৫জনের মরদেহ উদ্ধার করে। এ মাসে পানিতে ডুবে ২জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ৯জন, বজ্রপাতে ১জন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ১জন জেলাখানায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়। এমাসে ধর্ষণের অভিযোগ একটি ও শিশু ধর্ষণের অভিযোগ একটি হয়েছে।
এদিকে সাতক্ষীরা জিআরও অফিস সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে দুটি খুন হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬টি, অন্যান্যভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪১টি, সিধেল চুরি ৩টি অন্যান্য চুরি ১৬টি, সড়ক দুর্ঘটনায় ৪টি, মানব পাচার ৩টি, পর্ণো গ্রাফি ১টি, চোরচালন ১০টি, মাদক দ্রব্য ১৭৯টি অন্যান্য খাতে রুজুকৃত মামলা ২৪২ টিসহ ৫১৩টি মামল হয়েছে।
সাতক্ষীরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের তথ্য অনুযায়ী তিন মাসে নারী শিশু মামলা ১০২টি। বিগত কয়েক মাসে ২৫২৭টি মামলার মধ্যে ৯৮টি নিষ্পত্তি হয়েছে খালাস হয়েছে ৯৬টি এর মধ্যে সাজা হয়েছে দুটি। তিন মাসে ২টি মানব পাচার মামলা হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে ৯৯টি মানব পাচার মামলার মধ্যে ৩টি নিষ্পত্তি হয়েছে খালাস হয়েছে ৩টি। তিন মাসে ৯টি শিশু মামলা। বিগত কয়েক মাসে ৫০৮টি শিশু মামলার মধ্যে ১৬টি নিষ্পত্তি, ১৬টি খালাস হয়েছে।

Check Also

ব্যয় ৫২৭ কোটি টাকা: জানুয়ারিতেই নতুন বই পাচ্ছে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) এবং দাখিল ও কারিগরির ষষ্ঠ এবং সপ্তম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।