ব্যাংক ও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে তিন পন্থায় এগোতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে-নতুন কোনো ঋণ যাতে খেলাপি না হয় সেদিকে কঠোর তদারকি জোরদার করা, যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে সেগুলো থেকে আদায় বাড়ানো এবং দুই বছরের পুরোনো খেলাপি ঋণ অবলোপন করা।
রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রথমবারের মতো ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এর আলোকে অচিরেই আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যেগুলো সার্কুলার আকারে জারি করা হবে।
এর বাইরে ব্যাংকগুলোকেও আলাদাভাবে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক কোম্পানিগুলোর জন্যও আলাদা কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারণ আর্থিক কোম্পানিগুলোতেও নানা সমস্যা ভর করেছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে সংস্কারের জন্য দাবি ছিল ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠন করা। সরকার সেটি না করে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এটি কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে তারা সরকারের নিকটজন। তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটুকু কঠোর হতে পারে তা দেখার বিষয়।
তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে দেশে সুশাসন নিশ্চিত না হলে শুধু ব্যাংক খাতে তা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আর সুশাসন না হলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
সূত্র জানায়, গত জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে। জুনে ছিল মোট ঋণের ১০ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপি। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে। পরিমাণও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা কমেছে। তারপরও খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এগুলোও খেলাপি। এছাড়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লুকানো মিলে মোট খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার ওপরে হবে বলে আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর বাইরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। যা তাদের বিতরণ করা ঋণ বা লিজের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, রোডম্যাপের আলোকে ব্যাংকগুলোতে নতুন ঋণখেলাপি হওয়া ঠেকাতে আগে থেকেই তদারকি জোরদার করা হবে।
এর মধ্যে যেসব ঋণ খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে চলে যাবে ওইসব ঋণ নিয়মিত করা বা আদায় করার ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো হবে। কোনো ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধিত না হলেই তা বিশেষ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এ হিসাবে ঋণ রয়েছে ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণ থেকে যাতে কোনো গ্রাহক খেলাপি না হয় সেদিকে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
একই সঙ্গে কোনো গ্রাহকের যৌক্তিক কোনো সমস্যা হলে তা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে ঋণ নিয়মিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোক্রমেই এসব ঋণ যাতে খেলাপি না হয় ব্যাংকগুলোকে সেভাবেই তদারকি করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ঋণ খেলাপি হবে কিনা তা বিতরণের আগেই ব্যাংকাররা বুঝতে পারে। গ্রাহকের সম্পদ ও ব্যবসার ধরন থেকেই তা বোঝা যায়। ফলে যেসব ঋণ খেলাপি হবে বলে ব্যাংকারদের কাছে মনে হবে সেগুলো বিতরণের আগেই আটকে দিতে হবে।
এর মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সীমার বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। বর্তমানে কোনো একক গ্র“প বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ৩৫ শতাংশ ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে নগদ আকারে ১৫ শতাংশ ও পরোক্ষ ঋণ যেমন ব্যাংক গ্যারান্টি, এলসি এসব ২০ শতাংশ। এর বেশি ঋণ বিতরণ করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। অনেক গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের অনুমোদন দিয়েছে।
রোডম্যাপে বলা হয়েছে, এখন থেকে এ ধরনের ঋণের আর কোনো অনুমোদন দেওয়া হবে না। ফলে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ কমে যাবে। এতে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিও কমে যাবে। এছাড়া কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাইরে এ ধরনের সীমার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া ঋণ বিতরণের সময় বিভিন্ন গ্রাহকের ঋণের একটি সীমা দিয়ে দেন। ওই সীমার মধ্যে থেকেই গ্রাহকদের লেনদেন করতে হয়। এ সীমাও ব্যাংকগুলোকে মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হবে। সীমা বাড়াতে চাইলে ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে।
এ দুটি নীতি বাস্তবায়ন করতে পারলে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমানো সম্ভব। এতে খেলাপি ঋণ ঠেকানো যাবে প্রায় ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ঋণ বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধেও থাকবে কঠোর তদারকি। এতেও খেলাপি ঋণ ঠেকানো সম্ভব হবে।
এখন খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য দেওয়া হবে। সেগুলো আদায় বা নিয়মিত করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।
ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণ আছে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এগুলো সবই দুই বছর ধরে খেলাপি হিসাবে রয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রেখে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা নতুন করে অবলোপন করা সম্ভব। ফলে ওই পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমবে। তবে ঋণ অবলোপন করলে এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোতে অর্জিত মুনাফার অর্থ এ খাতে স্থানান্তর করতে হবে। ফলে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা লভ্যাংশ পাবেন কম।