নষ্ট হচ্ছে সাতক্ষীরার কোটি কোটি টাকার ‘কুল’

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সংরক্ষণের অভাব,পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং আন্তজার্তিক বাজারে ব্র্যান্ডিং করতে না পারায় সাতক্ষীরার সম্ভবনাময় কোটি কোটি টাকার ‘কুল’ শুকিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে। লোকসানে শেষ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পুঁজি-পাটা। সাতক্ষীরার বড় বাজার, পাটকেলঘাটা বাজার, ঝাউডাঙ্গা বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে,সব জায়গাতেই বাউকুল, অ্যাপেল কুল, মিষ্টি কুল, নাইন্টি কুল, বিলেতি কুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু ক্রেতা নেই। ফলে কুলে এবছর ৫শ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছে চাষিরা।
এবছর জেলাতে ৯৫০ হেক্টর জমিতে ১৭ হাজার টন কুল উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। যার বাজার মূল্য ১৩শ কোটি টাকার নিধারণ করা হয়ে ছিল। সব ঠিক থাকলেও বাজারে কুলের কাঙ্খিত চাহিদা না থাকায় কুল চাষিরা চরম হতাশায় পড়েছে। চাষিরা জানান, গত মৌসুমে যে কুল ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, এই মৌসুমে তা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তাও মানুষ নিতে চাচ্ছে না।

কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সাতক্ষীরার মাটি কুল চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় ২০০০ সালের পর থেকে এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু হয়। ফসলটি লাভজনক হওয়ায় অন্যান্য ফসল উৎপাদন কমিয়ে জেলার শত শত কৃষক কুলচাষ শুরু করেছে। চলতি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলাতে ৯৫০ হেক্টর পরিমাণ জমিতে কুল চাষ হয়েছে। যা গত আট বছরের ব্যবধানে প্রায় ৫০ শতাংশ আবাদ বেড়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, ২০১৫ সালে জেলাতে কুলের চাষ হয়ে ছিল ৪৫০ হেক্টর জমিতে। যেখানে ২০১৯ এ জেলায় কুলের আবাদ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫০ হেক্টর জমিতে। জানা গেছে, সাতক্ষীরার জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বছরে ১৭ হাজার টন কুল উৎপাদন হবে। এর মধ্যে তালা ও কলারোয়া উপজেলাতে সবচেয়ে বেশি কুল উৎপাদন হয়ে থাকে। যার গড় মুল্য ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার উপরে। এ জেলার উৎপাদিত কুল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে কুল অল্প সময়ে অধিক মুনাফা হওয়াতে জেলায় প্রতি বছর বাড়ছে কুলের আবাদ।

চাষিরা বলছেন, কুল চাষে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। প্রতি কেজি কুলের পাইকারি মূল্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সব খরচ বাদে বিঘা প্রতি ৯০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই ‘সাতক্ষীরার কুল’। এখানের মাটি ও আবহাওয়া কুল চাষের জন্য অনুকূল মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই কুল এখন চাষিদের গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। চলতি মৌসুমেবাজারে কুলের চাহিদা না থাকায় স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে কুল বিক্রি প্রায় শূন্যের কোটায়। তাই অধিকাংশ কুল অবিক্রিত থাকছে। তারা জানান, জেলাতে যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে, বাইরে পাঠাতে না পারায় স্থানীয় বাজারগুলোতে কুল উঠেছে চাহিদার কয়েক গুণ বেশি। তাই দাম নেই। যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতেও কেউ কিনতে চাচ্ছে না। বাজারেই শুকিয়ে লাল হয়ে নষ্ট হচ্ছে কুল। এতে সর্বশান্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

জেলার কলারোয়া উপজেলার কোমরপুর গ্রামের স্কুলশিক্ষক লাল্টু জানান, গত পাঁচ বছর ধরে নিজের জমিতে তিনি কুল চাষ করছেন। গত বছর ১০ বিঘা জমিতে আপেলকুল উৎপাদন করে লাভ করেছেন সাড়ে ৪ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘অন্যসব ফসলের চেয়ে কুল চাষ খুবই লাভজনক। মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন মাসেই ফল পাওয়া যায়। ধান, পাট বা সরিষা উৎপাদনে এত বেশি লাভ সম্ভব হয় না। তাছাড়া নিরাপত্তাঝুঁকিও কম।’ এ স্কুলশিক্ষক আরো বলেন, ‘১০ বিঘা জমিতে তার কুল চাষ করতে ৫ লাখ টাকার মতো খরচ পড়ে। সেখানে ফল বিক্রি হয় ৯-সাড়ে ৯ লাখ টাকার। কিন্তু এবছর কুলের দাম অনেক কম। যেকারণে লাভের চেয়ে ক্ষতি হতেদ পারে বেশি।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমের মতোই সাতক্ষীরার কুলের নাম দেশজুড়ে। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া কুল চাষের জন্য অনুকূল হওয়ায় এর চাষাবাদ বাড়ছে। চলতি মৌসুমেও সাতক্ষীরায় কুলের বাম্পার ফলন হয়েছে। যা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে স্থান করে নিয়েছে। কম খরচে কৃষক এ চাষে ভাল লাভ করায় এটি আমাদের জেলার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। তবে কুলের বর্তমান দাম কম থাকলে চাষিদের ক্ষতি হবেনা বলে আশাবাদী এই কৃষিবিদ।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।