চুয়াডাঙ্গার কৃষকেরা বছরে তিনটি মৌসুমে সবজি উৎপাদন করেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সবজির একটি বড় অংশ পাঠানো হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে। কৃষকেরা এতে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তবে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার খাবার টেবিলে পৌঁছানো পর্যন্ত সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি সার ও বালাইনাশকসহ ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত রোগবালাইয়ের ধরন বুঝে শাকসবজিতে বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মোড়কের গায়ে জমি ও ফসল অনুযায়ী পরিমাপ লেখা থাকে। কিন্তু কৃষকেরা সবজিতে কীটনাশক ও বালাইনাশক ব৵বহারে ওই নির্দেশনা মানেন না।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) কায়সার ইকবাল প্রথম আলোকে জানান, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে বালাইনাশক প্রয়োগের পর খাওয়ার জন্য ন্যূনতম এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিন পর খেত থেকে সবজি তুলতে হয়। কিন্তু চাষিরা বিকেলে খেতে বালাইনাশক ছিটিয়ে পরদিন সকালেই সবজি বাজারে নিয়ে আসেন। অপেক্ষমাণকাল না মানায় শাকসবজির সঙ্গে সরাসরি বিষ শরীরে প্রবেশ করছে, যা আমাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।’
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার সার্জারি–বিশেষজ্ঞ একরামুল হক জোয়ার্দ্দার তিনি বলেন, ২০১৩ সালে জাতিসংঘের স্টকহোম কনভেনশনে কৃষিতে ব্যবহৃত ১২টি রাসায়নিককে তালিকাভুক্ত করে তাকে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব রাসায়নিক মেশানোর পর ভালো করে ধুলেও সবজি শতভাগ পরিষ্কার ও নিরাপদ হয় না। ওই সবজি খেলে কিডনি, লিভার, স্তন, ফুসফুস, পাকস্থলী, প্রস্টেট, অগ্নাশয় ও ব্লাড ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। একরামুল বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সচেতন করতে হবে। অর্গানিক উপায়ে খাবার উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি খরিপ-১ মৌসুমে জেলায় ৭ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে অন্তত ২৬ ধরনের সবজি আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদিত সবজির পরিমাণ ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন। সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতেই আবাদ করা হয়েছে বেগুন। এ ছাড়া ৭৯০ হেক্টরে পটোল, ৬৮০ হেক্টরে পেঁপে, ৫৫০ হেক্টরে শিম, ৫১০ হেক্টরে লাউ, ৪৮৩ হেক্টরে ফুলকপি, ৪৬৫ হেক্টরে কচুমুখী ও ৩৭০ হেক্টরে শসা আবাদ করা হয়েছে।
গত সোমবার সদর উপজেলার একাধিক গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সবজিখেতে ব্যস্ত দেখা যায়। গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক খোকন আলী খেত থেকে বেগুন তুলতে তুলতে জানান, এবার ১৫ কাঠা জমিতে বেগুন আবাদ করেছেন। প্রতি কেজি বেগুন পাইকারি ৫০ টাকা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আগের দিনও (রোববার) তিনি বেগুন খেতে দুই প্রকার বালাইনাশক ছিটিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘বর্তমানে বিষমুক্ত কোনো সবজি নেই।’
কৃষক রওশন কবীর একই মাঠে ১৫ কাঠা জমিতে শিম চাষ করেছেন। রওশন জানান, চার দিন আগে চার ধরনের বালাইনাশক মিশিয়ে খেতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বালাইনাশক দিলি কুনু খতিই হয় না। ২৪ ঘণ্টার মদ্দি নিওরে (শিশির) ধুয়ে যায়।’
ডিঙ্গেদহ হাটখোলা এলাকার কৃষক দোয়াল্লিন মোল্লা একটি সবজি খেতে নিয়ে যান এ প্রতিবেদককে। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের জন্য এই খেত তৈরি করা হয়েছে। যেখানে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়নি। তিনি স্বীকার করেন, পোকার কবল থেকে রক্ষা, তরতাজা ও আকার বড় করতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যবহার না করলে আকারে ছোট হবে, পোকায় খাবে এবং সবজি খারাপ দেখাবে। এ ধরনের সবজি ক্রেতা পছন্দ করবেন না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, বীজ থেকে শুরু করে বীজতলা এবং পরবর্তী অন্য সব পরিচর্যায় বালাইনাশক ব্যবহারের যে ক্ষতিকর দিকগুলো আছে সে বিষয়ে সচেতন করতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘বালাইনাশকের প্যাকেটে একটি ওয়েটিং পিরিয়ড (ব্যবহারের সময়সীমা) লেখা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক তা যথাযথভাবে মানেন না। তাই উৎপাদন থেকে ভোক্তাপর্যায়ে সবাই যদি সচেতন হতে না পারি, তাহলে নিরাপদ সবজি পাওয়া যাবে না। তাই কৃষক ভাইদের প্রতি আমাদের পরামর্শ অনুসরণ করে ফসল ফলানোর অনুরোধ জানাচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, অনিরাপদ খাদ্য বাজারজাত বা উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটিকে নজরদারির ভেতরে আনতে হবে। সেই লক্ষে৵ আমরা কাজ করছি। অনিরাপদ খাবার যাতে কেউ বাজারজাত করতে না পারেন, সে জন্য নিয়মিত মনিটরিং অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চুয়াডাঙ্গা কার্যালয়ের নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা সজীব পাল বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে আমরা আইন প্রয়োগের চেয়ে সচেতনতামূলক প্রচারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। সবজি ইনস্ট্যান্ট টেস্ট (তাৎক্ষণিক পরীক্ষার জন্য) করার জন্য রি-এজেন্ট প্রয়োজন। যা ধাপে ধাপে পেয়ে যাব।