বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে চিংড়িঘেরের ব্যবসা। কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীবেষ্টিত উপজেলায় ১২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের শতাধিক জায়গায় কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেড়িবাঁধ। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। মানুষ বসতভিটা হারানোর পাশাপাশি নোনাপানির বিরূপ প্রভাবে উজাড় হচ্ছে বনজ ও ফলদ সম্পদ।

এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, নোনাপানি ঢোকানোয় আবাদি জমি ও গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। বাঁধ কাটাছেঁড়া করায় ছোটখাটো দুর্যোগে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা আছে। জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ঘের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবছর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও দৃশ্যমান কিছু নেই।

আমার নির্বাচনী এলাকার নদীর বাঁধের নিচ দিয়ে চিংড়িচাষিদের হাজার হাজার পাইপ ঢোকানো আছে। যদি এমন করে বাঁধ ছিদ্র করা পাইপে প্রতিনিয়ত নোনাপানি যাওয়া-আসা করে, তাহলে সেই বাঁধ মজবুত হবে কীভাবে? ভঙ্গুর বাঁধগুলো যেকোনো দুর্যোগে আবারও উপকূলের মানুষের সাজানো সংসার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, কিছু ব্যক্তি নিজেদের মুনাফার জন্য সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে জাতীয় সংসদে খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান তাঁর এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষায় নোনাপানির চিংড়ি চাষ বন্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার নদীর বাঁধের নিচ দিয়ে চিংড়িচাষিদের হাজার হাজার পাইপ ঢোকানো আছে। যদি এমন করে বাঁধ ছিদ্র করা পাইপে প্রতিনিয়ত নোনাপানি যাওয়া-আসা করে, তাহলে সেই বাঁধ মজবুত হবে কীভাবে? ভঙ্গুর বাঁধগুলো যেকোনো দুর্যোগে আবারও উপকূলের মানুষের সাজানো সংসার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’

আরও পড়ুন

অরক্ষিত বেড়িবাঁধ যেন উপকূলবাসীর কান্না

অরক্ষিত বেড়িবাঁধ যেন উপকূলবাসীর কান্না

কয়রার দশহালিয়া থেকে হোগলা পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের তিন কিলোমিটার বাঁধে অন্তত ৫০টি স্থানে পাইপ বসানো দেখা গেছে। মঠবাড়ি এলাকার শাকবাড়ীয়া নদীর বাঁধ ছিদ্র করে বসানো হয়েছে ২৫টি পাইপ। ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে দশহালিয়া ও মঠবাড়িতে বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। ভেঙে যাওয়া স্থান পরে মেরামত করে পাউবো। সেখানেও পাইপ বসিয়ে নোনাপানি ওঠাতে দেখা যায়।

এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, নোনাপানি ঢোকানোয় আবাদি জমি ও গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। বাঁধ কাটাছেঁড়া করায় ছোটখাটো দুর্যোগে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা আছে।

উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, আশির দশকে কয়রায় বাণিজ্যিকভাবে নোনাপানির চিংড়ি চাষ শুরু হয়। কয়েক বছরে তা পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে কয়রায় মোট কৃষিজমি আছে ২৭ হাজার ২৭৪ হেক্টর। এর মধ্যে ৬ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে অপরিকল্পিতভাবে নোনাপানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

কয়রার বেড়িবাঁধ সংস্কার নিয়ে দাপ্তরিক টানাটানি

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাশ বলেন, কয়রায় মাত্র ৪০৫ হেক্টর জমিতে আধা নিবিড় ও সমন্বিত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। বাকি ঘেরেই নোনাপানি তুলে সনাতনপদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। তাঁরা চাষিদের আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।

বাঁধের যেসব স্থানে পাইপ বসানো আছে, দুর্যোগের সময় সেগুলো ভেঙে যায়। এতে শুধু সাধারণ মানুষের নয়, সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরুতে চিংড়িঘেরের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তখন উপজেলা সমন্বয় সভায় ২০২৩ সাল থেকে উপজেলার কোথাও নদী থেকে লোকালয়ে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের করা যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুস সালাম স্বীকার করেন, তাঁরা প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। মাইকিং করে পাইপ সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিলেও ঘেরমালিকেরা তা অগ্রাহ্য করছেন।

জরিপে ১২০ কিলোমিটার বাঁধ এলাকায় পাউবোর স্লুইসগেট আছে ১৭টি। অথচ চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধের ৫২১ জায়গায় কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।

২০১৮ সালে কয়রার ১২০ কিলোমিটার বাঁধ নিয়ে জরিপ করে বেসরকারি সংগঠন জাগ্রত যুব সংঘ (জেজেএস)। জরিপে ১২০ কিলোমিটার বাঁধ এলাকায় পাউবোর স্লুইসগেট আছে ১৭টি। অথচ চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধের ৫২১ জায়গায় কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, বাঁধের যেসব স্থানে পাইপ বসানো আছে, দুর্যোগের সময় সেগুলো ভেঙে যায়। এতে শুধু সাধারণ মানুষের নয়, সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো ঘের না থাকার নির্দেশনা আছে। কিন্তু বাঁধের পাশে পাউবোর জমি না থাকায় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কয়রার বাঁধ এত দিন সাতক্ষীরা পাউবোর আওতাধীন ছিল। সম্প্রতি খুলনার পাউবো দায়িত্ব পেয়েছে। এখন যাঁরা অবৈধভাবে বাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে নোনাপানির চিংড়ি চাষ করছেন, তাঁদের তালিকা করা হচ্ছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Check Also

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ দেবে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন

কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে বিভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সচিবালয় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।