আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার কিংবদন্তী-মরহুম কাজী শামসুর রহমানের ১৮ তম মৃত্যু বাষিকী আজ। ২০০৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি এদিনে তিনি সকল কে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পরোলোক গমন করেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ বাংলার উন্নয়নের অন্যতম রূপকার। নিরলস সমাজকর্মী, সফল সংগঠক, ইসলামী চিন্তাবিদ, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি, সাতক্ষীরা সদর আসনের তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, মরহুম কাজী শামসুর রহমান।
তিনি ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরা সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে দায়িত্ব পালনকালে ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য, হিসাব কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্ব¡পূর্ণ পদে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ, প্রস্তাব ও বিল উত্থাপনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সংসদের মসজিদে আজান ও নামাজের ব্যবস্থা, সাতক্ষীরায় আড়াই শ’ শয্যার হাসপাতাল ও ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, স্বল্প খরচে সমুদ্রপথে সহজ শর্তে হজ¦ করার ব্যবস্থা, সাতক্ষীরা আলিয়া মাদরাসা সরকারীকরণ, পতিতাবৃত্তি চালু রাখার ব্যবস্থা রহিতকরণ, সেনা, পুলিশ ও বিডিআর বাহিনীতে নামাজ আদায়ের সময় নির্দিষ্টকরণ এবং তাদের পারিবারিক সুবিধাসংক্রান্ত প্রস্তাব সংসদে তিনি পেশ করেছিলেন। কাজী শামসুর রহমান কর্মময় জীবনে মানুষের কল্যাণে যেসব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ সাতক্ষীরা শহর ও গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট তৈরি এবং আধুনিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে সরাসরি টেলিফোন ডায়ালিং ব্যবস্থার প্রবর্তন। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, মন্দির ও সেবা আশ্রমসহ নানা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক উন্নয়ন ও আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিৎিসাকেন্দ্র, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, ব্লাড ব্যাংক, মহিলাদের পোস্টমর্টেমে মহিলা ডাক্তার নিয়োগ, রোগীদের আর্থিক অনুদান দেয়াসহ নানা রকম উন্নয়নমূলক কাজ করতে সক্ষম হন। সাতক্ষীরা সদর সাইক্লোন ও দুর্যোগ মোকাবেলা কেন্দ্র তারই অবদান। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পল্লীবিদ্যুৎ পৌঁছানো, কালিগঞ্জ ও আশাশুনি ব্রিজনির্মাণ এবং নাভারন থেকে সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টে বিশাল হাইওয়ে নির্মাণের জন্য তার নেতৃত্বে জামায়াতের এমপিরা সংসদে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
১৯৩৭ সালে সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর গ্রামে কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি স্কলারশিপ নিয়েই লেখাপড়া করেছিলেন। পিএন হাইস্কুল থেকে ১৯৫৪ সালে মেট্রিক, সাতক্ষীরা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে আইএ এবং ১৯৬১ সালে বিএ পাস করেন। রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে বিএড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর থেকে ১৯৬৫ সালে এমএড অর্জন করেন। তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত, সাতানি ভদড়া হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক, লাবসা জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, কালিগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, সাতক্ষীরার পল্লীমঙ্গল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও নাইট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই মহান মানুষটি সম্পর্কে তিনি একটি গল্পও কথিত আছে। গল্পটার সত্যতা আমি আরও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম সাতক্ষীরার অনেকেই গল্পটা জানেন। তাই সবার সাথে এখানে শেয়ার করার চেষ্টা করছি। মরহুম কাজী শামসুর রহমান তখন দ্বিতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার বাড়ী ছিল এমন জায়গায় যেখানে চতুর্পাশে বিরোধী পক্ষের লোকজনের বাসা-অফিস ইত্যাদি। নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় জামায়াত বিরোধী পক্ষের লোকজন সেদিন খুবই উত্তেজিত ও ক্ষীপ্ত অবস্থায় ছিল। এমনিতে তারা কাজী শামসুর রহমান সাহেবকে খুব সম্মান করতো কিন্তু সেদিন তারা এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে তাদের হিতাহিত জ্ঞানটুকুও কাজ করছিল না।
তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে তারা ঐ রাতেই কাজী শামসুর রহমানের বাড়ী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে। যেই কথা সেই কাজ। তারা কেরোসিন নিয়ে নবনির্বাচিত এমপি সাহেবের বাড়ীর পাশে পৌছালো। গিয়ে দেখতে পেলো, পুরো বাড়ী অন্ধকার, সবাই ঘুমুচ্ছে। শুধু একটা ঘরে বাতি জ্বলছে। আলো জ্বলছে দেখে তারা আগুন দিতে প্রাথমিকভাবে একটু ইতস্তত বোধ করছিল। তারপর তাদেরই একজন লুকিয়ে লুকিয়ে সেই ঘরের নিকটে গেলো। পরবর্তীতে অন্যরাও সেখানে পৌছালো। গিয়ে দেখে, ভেতর থেকে কে যেন কি পড়ছে। উকি দিয়ে দেখে, নতুন এমপি কাজী শামসুর রহমান সাহেব অত রাতেও না ঘুমিয়ে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করছেন। তারা আরো ঘাবড়ে গেল। তারপরও তাদের মাথা যেহেতু ঠিক ছিলনা, দু একজন বোধ হয় নেশাগ্রস্থও ছিল, তাই তারা আগুন দেয়ার চেষ্টা শুরু করলো। দুতিনবার কেরোসিন দিয়ে ঘরের খড়ে আগুন দেয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু আগুনই ধরলো না। সিগারেটের লাইটার দিয়েও চেষ্টা করে কাজ হলোনা। তারপর তারা ফিরে গেল। একটু পর আবার আসলো। সেবারও পারলোনা। তারপর আবার আসলো। সেবারও গিয়ে দেখে এমপি সাহেব কুরআন শরীফ পড়েই যাচ্ছেন। এবারও আগুন লাগানোর চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হলো। এরই মধ্যে তাদের আওয়াজ শুনে এমপি সাহেব উঠে এলেন। তারা তাকে দেখে যেন সম্বিত ফিরে পেলো। তারা এমপি সাহেবকে গোটা ঘটনাটা খূলে বললো, এবং তার কাছে ক্ষমা চাইলো। মরহুম কাজী শামসুর রহমানও তাদেরকে নি:শর্তভাবে ক্ষমা করে দিলেন। এভাবেই সাতক্ষীরায় মরহুম কাজী শামসুর রহমানের জনপ্রিয়তা ও গ্রনযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। সুবহান আল্লাহ। আল্লহ মরহুম কাজী শামসুর রহমানকে জান্নাতের প্রশংসিত স্থান দান করুন। আমীন।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …