কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম ঘিরে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খালে দীর্ঘ দুই মাস কাঁকড়া আহরণ বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা শেষে উপকূলের জেলেরা আবারও কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে নৌকা নিয়ে নেমেছেন। বন বিভাগ থেকে অনুমতিপত্র পেয়ে আজ শুক্রবার সকাল থেকে তাঁরা কাঁকড়া ধরতে যাচ্ছেন।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। জলভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল আছে। এসব খালে ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এ দুই মাস কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম হওয়ায় ৫৯ দিনের জন্য জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশ করে কাঁকড়া ধরার অনুমতি বন্ধ রাখে বন বিভাগ।
আজ সকালে গিয়ে দেখা যায়, সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের পাশের শাকবাড়ীয়া নদীর পাড় থেকে কাঁকড়া ধরার সরঞ্জাম নৌকায় তুলছেন জেলেরা। নৌকার সামনের অংশে প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই রেখে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন সুন্দরবন যাত্রার। কেউ অনুমতিপত্র (পাস) না পেয়ে বন বিভাগের কার্যালয়ের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছেন। আবার কেউ অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছেন।
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল কুমার জানান, সুন্দরবনের মধ্যে অভয়ারণ্য ঘোষিত ৩০টি খাল এবং ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত খালে সারা বছরই কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বাকি অংশের নদী ও খালে বৈধ পাস-পারমিটধারী প্রায় ১৫ হাজার জেলে শুধু কাঁকড়া আহরণ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ১৯৯৮ সালে কাঁকড়া রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়নের পর থেকেই প্রতিবছর দুই মাস কাঁকড়া ধরার পাস–পারমিট বন্ধ রাখা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা আজ শুক্রবার থেকে শেষ হয়েছে।
জেলে পরিবারে ফিরেছে স্বস্তি
কয়রার পাথরখালী এলাকার কাঁকড়া ধরার জেলে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থিকভাবে সচ্ছল কোনো লোক সুন্দরবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁকড়া ধরতে যান না। যাঁরা যান, তাঁরা প্রায় সবাই দরিদ্র। দুই মাস নিষেধাজ্ঞা চলাকালে আমরা মতো দরিদ্র জেলেদের চরম দুর্দিন গেছে। বন্ধের দিনগুলোয় সরকারি কোনো ভাতার ব্যবস্থা না থাকায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। আজ সকালে কাঁকড়া ধরার অনুমতি পেয়ে স্বস্তি পেয়েছি।’
কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের সামনের নদীতে বেঁধে রাখা নৌকার পাটাতনে কাঁকড়া বাঁধার সিনথেটিক সুতা সাজিয়ে রাখছিলেন জেলে আবুল কাশেম। তিনি জানান, সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরেই চার সদস্যের সংসার চালান। এলাকায় অন্য কোনো কাজ নেই। কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকায় বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হয়েছে। গত দুই মাস সংসার চালাতে মহাজনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে কাঁকড়া ধরে ঋণ পরিশোধের আশা তাঁর।
অবৈধভাবে কাঁকড়া ধরার অভিযোগ
তবে জেলেদের অভিযোগ, বন বিভাগ যে উদ্দেশ্যে দুই মাসের কাঁকড়া ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা সফল হয়নি। কারণ, প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ হলেও তা উপেক্ষা করে অসাধু জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে ডিমওয়ালা মা কাঁকড়া শিকার করছেন। এতে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তাঁদের।
কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন গড়িয়াবাড়ী গ্রামের স্কুলশিক্ষক অরবিন্দ মণ্ডল বলেন, গত দুই মাস অবৈধ কাঁকড়া আহরণ বন্ধে বন বিভাগ বেশ কঠোর ছিল। তবুও সুন্দরবনে অবৈধভাবে চলেছে এই কারবার। এক সময়ের ছোট পরিসরের কাঁকড়ার বাজার এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। এখন কোনো রকম বাছ বিচার করেন না জেলেরা। চারো বা আটোন নামের বাঁশ দিয়ে তৈরি এক ধরনের ফাঁদ দিয়ে সুন্দরবনে ছোট-বড় সব কাঁকড়াই শিকার করা হয়। চুরি করে সুন্দরবনজুড়ে চলে এই অবৈধ কাজ।
কয়রার গোবরা এলাকার কাঁকড়া আহরণের জেলে আমিনুর রহমান জানান, সুন্দরবনে এখন তেমন মাছ পড়ে না। বর্তমানে কাঁকড়ার কারবারই বেশ লাভজনক। তবে ধরার পর কাঁকড়াগুলোকে বাঁচিয়ে অক্ষত অবস্থায় আড়তে ফিরতে না পারলে সেই চালানের কোনো দামই পাওয়া যায় না। দ্রুতগামী কোনো নৌযানের অনুমতি দেয় না বন বিভাগ। দূর সুন্দরবনে নৌকা বেয়ে আসতে হয়। আবার কাঁকড়া নিয়ে নৌকা বেয়ে ফিরতে হয় লোকালয়ে। ট্রলারে করে কাঁকড়া পরিবহন এখানে নিষেধ।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, কাঁকড়া বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুন্দরবনে বিভিন্ন নদী-খালে দুই মাস জেলেদের কাঁকড়া আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। ১ মার্চ থেকে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে জেলেরা প্রবেশনিষিদ্ধ অভয়াশ্রম ছাড়া অন্য নদী-খালে কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন। তবে কেউ যাতে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে, সে জন্য বনরক্ষীদের টহল ও অন্যান্য কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।