বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে বৃহত্তর ঐক্যের সুবাতাস

 জামশেদ মেহ্দী॥
অনেক দিন বলি কেন, বেশ কয়েক বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতি; বিশেষ করে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে অপসারণ করতে ব্যর্থতার পর বিরোধীদলের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে সাফল্য ও ব্যর্থতার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করা হয়। বর্তমানে বিরোধীদলের প্রধান তিনটি দল ও জোট যথা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়। এসব আলোচনার পর এ তিনটি রাজনৈতিক দল বা জোটের মধ্যে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, বিরোধীদলসমূহ; বিশেষ করে প্রধান দুটি বিরোধীদল, অর্থাৎ বিএনপি এবং জামায়াত মিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ফলে মাঠের রাজনীতিতে তারা পিছিয়ে পড়েছে।
কিন্তু এ বিপর্যয়ের পর সবগুলো দলই এটি অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছে যে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে সুকঠিন ঐক্য গড়ে তোলা কোনো দুরূহ ব্যাপার ছিল না। আদর্শগত প্রশ্নে দল দুটি দুই মেরুতে অবস্থান করছে না। বরং অনেকের তুলনায় এ দুটি দলের মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আদর্শগত মিল রয়েছে। রাজনীতিতে তখনই কোনো জোট বা মোর্চা গঠিত হয় যখন তারা তাদের আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচ্যুত না হয়েও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। জোটের রাজনীতি এ উপমহাদেশে মোটেই অজানা নয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আদর্শগত অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর আওয়ামী লীগ ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সাথে মাওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম এবং আবুল হাশিমের খেলাফতে রব্বানী পার্টির কোয়ালিশন বা মোর্চা হয়েছিল। অথচ আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে। পক্ষান্তরে নেজামে ইসলাম এবং খেলাফতে রব্বানী পার্টি ইসলামী সমাজব্যবস্থার কথা বলতো। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে ঐক্য হয়েছিল প্রধানত একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে। সেটি হলো, তৎকালীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার এবং তার মুখ্যমন্ত্রী নুুরুল আমিনকে অপসারণ করা। এসব দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঐতিহাসিক ২১ দফা প্রণীত হয়, যেটি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী মেনিফেস্টো বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের কথায় আসছি। জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনকে অপসারণ করার জন্য ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। এ জোটে একদিকে ছিল যেমন আওয়ামী লীগ; অন্যদিকে তেমন ছিল বিএনপি এবং তাদের সহযাত্রী ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এরশাদের পতনের পর তারা আলাদা হয়ে যায়। বিএনপি এবং জামায়াত ঐক্য জোট না হলেও নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলে এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বিএনপি সরকার গঠন করে। জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিলেও সরকারে যোগ দেয়নি। ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ উভয়েই চেষ্টা করে। জামায়াত আওয়ামী লীগের সাথে না যাওয়ায় তারা এরশাদকে দলে টানে। অন্যদিকে বিএনপি এবং জামায়াত মিলে নির্বাচন করায় আওয়ামী লীগ হেরে যায়। তখন থেকেই জামায়াতের ওপর যত ক্ষোভ এবং ক্রোধ আওয়ামী লীগের। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ কথা বলেও বেড়ায় যে, যদি জামায়াত বিএনপির সাথে না থাকতো, তাহলে ২০০১ সালে তারাই অর্থাৎ আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসতো।
এভাবে আওয়ামী লীগের মধ্যে যে ক্ষোভ এবং ক্রোধ পুঞ্জীভূত হয়, তারই সশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার পরই আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায় জামায়াতে ইসলামীকে শায়েস্তা করা। কারণ তারা বিলক্ষণ বুঝতে পারে যে, জামায়াতকে যদি শায়েস্তা করা না যায় এবং বিএনপি ও জামায়াতের মৈত্রী যদি অক্ষুণ্ন থাকে, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য সুদূরপরাহত হবে। প্রবীণ, অভিজ্ঞ এবং ভেতরের খবর যারা রাখেন, তাদের মতে আওয়ামী আমলে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতাদের অভিযুক্ত করা এবং শীর্ষনেতৃবৃন্দকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছিল অনেকটা “রাজনৈতিক প্রতিশোধ”।
এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী ঘরানা দ্বিমুখী স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে। একদিকে বিগস্টিক পলিসি, অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচার। অন্যদিকে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির জন্য জামায়াত সম্পর্কে অনেক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অপপ্রচার। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ একা ছিল না। ভারতের কংগ্রেস সরকার তো প্রকাশ্যেই বলেছিল যে, জামায়াত একটি ভারতবিরোধী দল। তাই জামায়াতকে শায়েস্তা করা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগেরই এজেন্ডা ছিল না, বরং ভারতপ্রেমী সবগুলো দলের এজেন্ডা ছিল। কারণ এটি ছিল মূলত ভারতীয় এজেন্ডা। তাই ভারতীয় ঘরানার সবশ্রেণির দল জামায়াতবিরোধী কনসার্টে যোগ দেয়। বাংলাদেশে এ ভারতীয় ঘরানাকে বলা হয় আওয়ামী ঘরানা।
আওয়ামী ঘরানার হাতে রয়েছে শক্তিশালী গণমাধ্যম এবং ততোধিক শক্তিশালী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম। ওরা নৃত্য গীতসহ যে ধরনের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে, সেটি জামায়াত মোটেই করে না। তাই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের উপযুক্ত পাল্টা জবাব দেওয়া জামায়াতের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ওপরে তাদের প্রধান মেন্টর ছিল বিজেপি এবং ভারত সরকার। বিএনপির এজেন্ডায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠন নেই। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের সাথে আওয়ামী লীগের খুব একটা বড় তফাৎ নেই। অন্তত ইন্ডিয়া ফ্যাক্টরকে বিবেচনা করে বিএনপি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের মোকাবিলা করতে পারতো। কিন্তু বিএনপি সেটি করেনি।
এ সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ঘটনাচক্রে ভারতীয় ঘরানার পক্ষে চলে যায়। ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার পর আমেরিকার কমিউনিস্টবিরোধী এজেন্ডার স্থলাভিষিক্ত হয় মৌলবাদের নাম করে ইসলামবিরোধী এজেন্ডা। এক্ষেত্রে ভারত তাদের বড় মিত্র হয়ে যায়। একদিকে বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা; অন্যদিকে ইন্দো-মার্কিন এবং পশ্চিমা বিশে^র মুসলিমবিরোধী অবস্থান। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মুসলিমবিরোধী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে কঠিন মূল্য দিতে হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোট গঠিত হলেও বিএনপি জামায়াতের প্রতি ইনসাফ করেনি। জামায়াতের যা প্রাপ্য ছিল সেটি তারা জামায়াতকে দেয়নি। জামায়াত তথা ২০ দলীয় জোটের পরিবর্তে তারা ড. কামাল হোসেনকে বিরোধীদলের নেতা বানায় এবং ঐক্যফ্রন্টকে অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে। অথচ ঐক্যফ্রন্ট কয়েকটি ছোট দলের সমষ্টি।
২০১৮ সালে কৌশলগতভাবে মার খেয়েও বিএনপি সচেতন হতে পারেনি। বরং ২০১৮ সালের পর শত্রু শিবিরের বিরূপ প্রচারণার ফাঁদে পড়ে বিএনপি জামায়াতকে দূরে ঠেলে দেয়। ২০২৩ সালের আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন পূর্ব বিভিন্ন জোটেও জামায়াতকে শামিল করা হয়নি। তবুও দেশ এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে জামায়াত আলাদাভাবে মাঠে নামে এবং তাদের সাধ্যমতো সরকার বিরোধী আন্দোলন করে।
প্রথমেই বলেছি যে, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ভণ্ডুল করায় ব্যর্থতা সম্ভবত সবগুলো বিরোধীদলের মধ্যে আত্মসংশোধনের সুযোগ এনে দেয়। অন্তত বিএনপি বুঝতে পারে যে, যত বড় বড় জনসভাই তারা করুক না কেন, মাঠে তারা বিগত ১৫ বছরে কোনো দিন মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগের পেশিশক্তির কাছে বিগত ১৫ বছর ধরে তারা মার খেয়েই চলেছে। কিন্তু যদি জামায়াত এবং বিএনপি একসাথে আন্দোলন করতো, তাহলে মার খেয়ে হলেও জামায়াত মাঠ থেকে পশ্চাদপসারণ করতো না।
এ বোধোদয় বিএনপির হয়েছে। বেগম জিয়ার ১৭ বছরের কারাদণ্ড হলো। কিন্তু বিএনপি বিবৃতি দেওয়া এবং সমালোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির পর প্রধান তিনটি বিরোধীদল দেখতে পাচ্ছে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে তাদের প্রতিকূলে চলে গেছে। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ৭ জানুয়ারির পর একদলীয় স্বৈরাচার নয়, প্রফেসর আলী রিয়াজের ভাষায়, Personalized Autocracy বা ব্যক্তি স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশে^র বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে গলা সপ্তমে চড়িয়ে প্রচার করলেও এ ভারত বাংলাদেশে ব্যক্তি স্বৈরাচারকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এখন সর্বশ্রেণির মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন যে ভারত যদি এবার আওয়ামী লীগকে তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে অন্ধভাবে সমর্থন না দিতো, তাহলে এবার আওয়ামী লীগ সরকার পড়ে যেত।
জামায়াতের প্রতি প্রথম দিকে গণতন্ত্র মঞ্চের একটি এলার্জি ছিল। কিন্তু তাদের সামনে হিমালয় সদৃশ্য ভারতপুষ্ট দানবীয় সরকার। তারাও বুঝতে পারছে যে, জামায়াতকে দূরে রেখে এ হিমালয়ান দানবীয় সরকারকে অপসারিত করা সম্ভব নয়। এদিকে জামায়াতও বুঝতে পেরেছেÑ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যে অশুভ শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে, তাকে মোকাবিলা করতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সব দলের ভেতর এ বিলম্বিত উপলব্ধির কারণেই এবং ৭ জানুয়ারির পর পর্দার অন্তরালে তৎপরতা চালানোর ফল হিসেবে এবার বিএনপির ইফতার মাহফিলে জামায়াত আমীর ড. শফিকুর রহমান এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে অতি ঘনিষ্ঠভাবে কানে কানে কথা বলতে দেখা গেছে। আর একটু দূর থেকে সেটি প্রসন্নচিত্তে লক্ষ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। গণতন্ত্র মঞ্চের অপর নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, আ স ম আব্দুর রব (যদিও তিনি অসুস্থ) প্রমুখ কারো আর রিজার্ভেশন নেই।
বাংলাদেশের মানুষ গভীর স্বস্তির সাথে লক্ষ করেছেন যে, জামায়াতের ইফতার মাহফিলেও বিএনপি নেতৃবৃন্দ শরিক হয়েছেন। গত ৩০ মার্চ হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে জামায়াতের ইফতার মাহফিলে শরিক হয়েছিলেন অন্যদের মধ্যে সাবেক স্পিকার বিএনপি নেতা জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস, মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ প্রায় ২০ জন নেতা।
জানা গেছে, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর বৃহত্তর ঐক্য গঠন এবং কঠোর গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য জামায়াতসহ ছোট বড় সব ধরনের রাজনৈতিক দলের সাথে বিএনপির আলোচনা শুরু হবে। কিছুটা সময় লাগলেও বর্তমান নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার সচল হবে। এরপর আবার গণআন্দোলনের সূচনা হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
Email: jamshedmehdi15@gmail.com

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।