আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীর বেড়ীবাঁধে ভাঙন ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ: অরক্ষিত বিস্তৃত এলাকা

মুজাহিদুল ইসলাম, সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার উপকূল রক্ষা বাঁধের ২৫টি জায়গা ভাঙনের মুখে। উপজেলার শ্যামনগর ও আশাশুনিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপকূল রক্ষা বাঁধে এই দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলীয় এলাকাতেই সাড়ে ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গ থেকে রক্ষা করার জন্য মূলত এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব বাঁধের স্থায়িত্ব ধরা হয় ২০ বছর। কিন্তু ৫০ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও যথাযথভাবে এগুলোর সংস্কার করা হয়নি। ফলে বিশাল বিস্তৃত এলাকা এখন অরক্ষিত। এদিকে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট বাজার সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর দীর্ঘ বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যে কোন মুহূর্তে বিস্তৃর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। এর ফলে প্লাবিত হতে পারে প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা ও বড়দল ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। সোমবার সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট বাজার থেকে হাজরাখালি খেয়াঘাটগামী খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত জরাজীর্ণ হয়ে রিংবাঁধে পরিণত হয়েছে। নদীর প্রবল জোয়ারের চাপ বা জোয়ারের সময় দমকা হাওয়া বা ঝড় বৃষ্টি বইলেই যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে জরাজীর্ণ নদীর এ বেড়িবাঁধ।

স্থানীয় বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, বেড়িবাঁধ স্থায়ীভাবে সংস্কার না হওয়ায় প্রতিবছর নদীর প্রবল জোয়ারের পানির আঘাতে নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙে রিং বেড়িবাঁধে পরিণত হয়। এলাকা প্লাবিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষের রেকর্ডিয় সম্পত্তির উপর দিয়ে বিকল্প বেড়িবাঁধ দিতে হয়েছে। এ সময় তিনি নদীর অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির উপর দিয়ে স্থায়ী, টেকসই নদী রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। তৌষিকে কাইফু বলেন, খোলপেটুয়া নদীর আদি গতিপথ হারিয়ে বিছট গ্রামের নদী সংলগ্ন কৃষি জমি ভাংতে শুরু করেছে। বিষয়টি সাতক্ষীরা-৩ আসনের সাংসদ অধ্যাপক ডা. আ. ফ. ম রুহুল হক এমপিকে অবহিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড পৌর বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী হাসান মিশুককে সাথে নিয়ে ভাঙন কবলিত স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। একই সাথে ভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। অতি দ্রুতই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক সংস্কার কাজ শুরুকরা হবে। এছাড়া টেকশই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দেশের বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সুপার সাইক্লোন সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৭৮ কিলোমিটার।

গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম বলেন, ‘গাবুরার দক্ষিণ–পশ্চিমে খেলপেটুয়া নদী, উত্তর–দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ। প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটারের গাবুয়া এখন কাগজে-কলমে ৩৩ বর্গ কিলোমিটার; আমাদের ছোটবেলায় দেখা অনেক জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে গত ৫০ বছরে। দ্রুত বাঁধ সংস্কার না হলে দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যেতে পারে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা।’ এ সমস্যা শুধু গাবুয়ার নয়। ষাটের দশকে উপকূলের ১৩ জেলায় ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার ১৩৯টি পোল্ডার (বেড়িবাঁধ) নির্মাণ করা হয়েছিলো। শুনতে আশ্চর্য শোনালেও সত্যিটা হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপকূল সুরক্ষায় নতুন একটি পোল্ডারও তৈরী করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে তৈরী বেড়িবাঁধ সংস্কার আর পুনঃনির্মাণেই কেটে গেছে ৫০টি বছর! অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৮ হাজার কোটি টাকার ৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। এছাড়া আরো কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শুধু বেড়িবাঁধ নয়, পুরো উপকূলের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত সুপার ড্রাইভওয়ে নির্মাণ, সুন্দরবন ও নদী সুরক্ষা, খাবার পানি সমস্যার সমাধানসহ অন্যান্য সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

Check Also

পুলিশ ভেরিফিকেশনে থাকছে না রাজনৈতিক পরিচয়

পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় তুলে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন এ সুপারিশ করেছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।