পুষ্টিগুণে ভরপূর কাঁচা আম: ঝড়ের-শঙ্কায় কাঁচা আম ভাঙছে সাতক্ষীরার চাষিরা

আমজাত পণ্য আমদানি বন্ধের দাবী
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ ঝড়ের-শঙ্কা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়ায় আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনার সূফল পাচ্ছে না আম চাষিরা। এছাড়া উৎপাদিত আমের সেলফ লাইফ কম থাকা, কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রপ্তানিযোগ্য উচ্চমূল্যের জাতের অপর্যাপ্ততা, নজরদারি, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানসম্পন্ন আমের জাত নির্বাচন ও উৎপাদনে ঘাটতি, নতুন বাজার যাচাই ও সৃৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণে সমন্বয়ের অভাবে এবার আগে ভাগে আম পাড়ছে সাতক্ষীরার আম চাষিরা। সাতক্ষীরা শহরের আম ব্যবসায়ী মোসলেম বলেন, এ বছর আমের ফলন কম। তার ওপর আবার বৃষ্টি না হওয়ায় গুটি ঝরে যাচ্ছে। যে টাকা দিয়ে বাগান কিনেছিলাম তা বিক্রি করে আসলে টাকা উঠবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।’ মুকুল আসার পর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এমনিতেই ফলন কম আমের। তার ওপর রয়েছে কালবৈশাখিসহ উপকূলীয় ঝড়ের শঙ্কা। অন্যদিকে কাঁচা আমের চাহিদা বেশি থাকায় তারা এখই গাছ থেকে আম পাড়ছে। জেলার বাজারে পাইকারদের আনাগোনা বাড়ায় প্রতিদিন শত শত মণ আম বেচাকেনা হচ্ছে। ফলে কাঁচা আমে ভরে গেছে বাজার। অন্য যে কোন বছরের তুলনায় এবার কাঁচা আমের দাম বেশি। গত এক সপ্তাহ ধরে সাতক্ষীরা বাজারগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে কাঁচা আম কেনা-বেচা শুরু হয়েছে। প্রতি মণ আম দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাই আম চাষিরা বলছেন, তারা যে লোকসানের মুখে পড়তেন কাঁচা আম বিক্রি করে কিছুটা স্বস্থি পাবেন তারা। এছাড়া বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের অভিশপ্ত প্রভাবে গ্রীষ্মকালে ৪০-৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং শীতকালে ৪-৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ৩৭% উর্বর জমি মরুভূমিতে পতিত হচ্ছে। তেমনি নতুন নতুন রোগ ব্যাধি দেখা দিয়েছে আমের ফলনে। ফলে বহুমুখী উপযোগিতা হারাচ্ছে তেমনি স্বাভাবিকভাবে আমের উৎপাদনও কমে আসছে।
বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম হলেও, পণ্যটি রপ্তানি আয়ের দিক থেকে একদমই তলানিতে ছিল। বাংলাদেশের চেয়েও কম পরিমাণ আম উৎপাদন করে অনেক দেশ রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। সরকারি হিসেবে গত বছর বাংলাদেশের আমের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্ব উৎপাদনের দুই দশমিক ছয় ভাগ। সপ্তম উৎপানকারী দেশ হয়েছেও বাংলাদেশ মাত্র পাঁচ লাখ মার্কিন ডলারের আম রপ্তানির সুযোগ পেয়েছে। বিশেজ্ঞরা বলছে, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি অতি নগণ্য।
আম চাষিরা বলছে, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সুস্বাদু জাতের আগাম আম উৎপাদন ও বাজারজাত করে দেশে সুনাম কুড়িয়েছে উপকূলবর্তী এ জেলা। এ অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থান উপযোগী হওয়া এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম এখানেই উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে আমের স্থায়ী রপ্তানি বাজার রয়েছে এবং এথনিক ও নিচি মার্কেটের সুবিধাও রয়েছে। বিধায় বর্তমানে বিদেশে আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি রপ্তানি ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া আম রপ্তানির জন্য বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমের মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো; আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান করা; এবং আম রপ্তানির জন্য একটি কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন দরকার।

সাতক্ষীরা বড় বাজারের আম ব্যবসায়ী আনিচুর রহমান জানান, ত্রিশ বছর ধরে তিনি এবাজারে ব্যবসা করছেন। সে তুলনায় এবছর বাজারে কাঁচা আমের পরিমাণ যেমন বেশি তেমনি দাম ও চড়া। প্রতিদিন জেলার সুলতান পুর বড় বাজার থেকে ৪/৫ ট্রাক কাঁচা আম দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। শাহজান জানান, কাঁচা আম কিনে বিভিন্ন কোম্পানি আচার, চাটনি, জেলি, কাঁচা আমের জুসসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। তাই বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা সাতক্ষীরা থেকে আম কিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠাচ্ছেন। আম ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে যে আমগুলো ভেঙে বাজারে বিক্রি করছি, সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানি এই আম আমাদের থেকে সংগ্রহ করছে।’

পুষ্টি বিশেজ্ঞরা বলছেন, কাঁচা আমে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টিগুণ থাকে। বিশেষ করে, ওজন কমাতে, বমি ভাব দূর করতে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, চুল ও ত্বক উজ্জ্বল করতে। এছাড়া ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও একাধিক অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। যা শ্বেত রক্তকণিকার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, বিদেশ থেকে বৈধভাবে যে পরিমাণ ফল আমদানি করা হয়, রপ্তানি করা হয় তার ৬২ ভাগের ১ ভাগ। বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম এবং আগাম জাতের আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা প্রথম। আম আমাদের দেশে মৌসুমি অর্থকরী ফল হিসেবে গুরুত্ব পেলেও একে শিল্পজাত পণ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাতকরণের কার্যকর গবেষণা অদ্যাবধি না নেয়ায় হুমকীর মুখে পড়তে যাচ্ছে আম চাষ
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে জলবায়ুু পরিবর্তন জেলার আমের উপর প্রভাব বিস্তর করেছে। এর পরও বিদেশে রপ্তানি হওয়া আম বাগানগুলোতে আগে থেকে তত্ত্বাবধান শুরু করে কৃষি বিভাগ। যেন কোনো চাষি ওই বাগানগুলোতে কীটনাশক প্রয়াগ করতে না পারে। সম্পূর্ণরূপে বিষমুক্ত আম রপ্তানি হয় বিদেশে।’

 

Check Also

আশাশুনি উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

সভাপতি-অধ্যাপক শাহজাহান,সেক্রেটারী বোরহান উদ্দীন মনোনীত এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন আশাশুনি উপজেলার দ্বি-বার্ষিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।