মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী শ্রমিকরা: পণ্য বিক্রয়ের জন্য আলাদা বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবী

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ পুরুষের সমান কাজ করলেও প্রাপ্ত মজুরি পাননা নারী শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ, একই জমিতে সমশ্রম দিলেও তাদের পুরুষের তুলনায় কোথাও অর্ধেক আবার কোথাও তিন ভাগের এক ভাগ মজুরি দেয়া হয়। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে, সেখানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। মাঠভিত্তিক কৃষিকাজ ও গৃহভিত্তিক কৃষিকাজ— এ দুটি পর্যায়েই নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবে কৃষিতে নারীর অবদান এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহসহ কৃষিকাজে সরাসরি অবদান রাখছেন কিন্তু তাদের শ্রমকে শ্রমশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না। কারণ তাদের এ কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। আন্তজার্তিক শ্রমিক দিবসে নারী-পুরুষভেদে সবাইকে সমান মজুরি দেয়ার দাবি তাদের। বছর ঘুরে শ্রমিক দিবস আসে। তখন নারী শ্রমিকদের মজুরিবৈষম্যের শিকার হওয়ার বিষয়টি জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। কিন্তু তাঁদের মজুরির কোনো পরিবর্তন হয় না। নারীদের পণ্য বিক্রির জন্য আলাদা বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিভিন্ন বৈষম্য দূর করা, নারীবান্ধব পরিবেশ এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রির জন্য পৃথক জায়গা প্রদান করা কৃষিতে জড়িত নারীরা দাবী জানিয়ে আসছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি হলেও মজুরি বৈষম্য যথাযথভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। মজুরি বৈষম্য নারী ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়। তাই প্রথমেই একটি মজুরি কাঠামো গঠন করতে হবে এবং নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কৃষিতে শ্রমদানকারী নারীদের ৪৫.৬ শতাংশ পারিশ্রমিক পান না। বাকি ৫৪.৪ শতাংশ বাজারমূল্যের থেকে কম পারিশ্রমিক পান। আর সর্বোপরি একজন নারীশ্রমিক পুরুষের থেকে ৪৩ শতাংশ কম মজুরি পেয়ে থাকেন। কর্মক্ষেত্রে নারীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি সময় কাজ করে থাকেন। যদিও এর জন্য তারা কোনও বাড়তি পারিশ্রমিক বা সুবিধা পান না। সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকার কারণে তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই এটা মেনে নেন। দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ নারীশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য হন। বেসরকারি সংস্থা অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে গত ১ দশকে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে বেড়েছে। যার ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের অধিকাংশই মজুরি বৈষম্যের শিকার। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভলপমেন্টের যৌথ এক গবেষণাপত্র ‘নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ন্যায্যতা’ থেকে জানা যায়, ৬১ শতাংশ নারী শ্রমিক দৈনিক ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ অনুযায়ী, ২০২২ সালের (সাময়িক) শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায় দেশে ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ কাজ করে। এরমধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৫ লাখ। শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকদের একটি বড় অংশই হলো গ্রামীণ নারী, যারা স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। স্বল্প শিক্ষার কারণে একদিকে তারা যেমন কম মজুরির ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হন তেমনি তারা উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন।
বর্তমানে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। কৃজের পাশাপাশি পশুপালন, বনায়ন, মৎস্য, ক্ষুদ্র ও বৃহৎশিল্পের সঙ্গেও জড়িত তারা। চলতি মৌসুমে রোপা আমন ধান ক্ষেত থেকে কেটে ঘরে তুলতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় দিন দিন উপকুলীয় জেলাগুলোতে কৃষিতে পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের চাহিদা বাড়ছে। ফসলের বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত বেশিরভাগ কাজ উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা এককভাবেই করে আসছে। নারীদের অভিযোগ পুরুষের সমান কাজ করলেও তারা মজুরি বৈষ্যম্যের শিকার। তারা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরি পান। যদিও সাতক্ষীরা জেলাতে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমানে দেশে নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষির সাথে জড়িত। ফসল উৎপাদনের ২১টি ধাপের ১৭টিতেই নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ রয়েছে। উপকূল জনপদেও এসব নারী-অবহেলা, বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার ভাগ্য বিড়ম্বিত এক জীবন। যে জীবনে সংকট নিত্যদিনের, নেই সমাধান। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারের বোঝা চাপে নারীর ওপর। পুরুষবিহীন সংসারে নারী হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান। অথচ কোথাও নেই এতটুকু স্বীকৃতি।
বাংলাদেশ সংবিধানে ২৮নং অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ফলে একদিকে যেমন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ছে, অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি বিশেজ্ঞরা বলেন, কৃষি খাতকে গতিশীল করতে হলে গ্রামিণ কৃষানিদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে হবে, যাতে তারা সহজেই কৃষিসংক্রান্ত তথ্য মোবাইলের মাধ্যমে পেতে পারেন। প্রণোদনা হিসেবে কৃষক কার্ডের মাধ্যমে সরকারের সহায়তা নিয়ে তা সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলেই নারীরা কৃৃষিতে নতুন বিপ্লব ঘটাতে পারবেন। সরকারি নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, বর্গা চাষি, নারী কৃষকের সংজ্ঞা থাকতে হবে এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীদের অবদানকে অর্থনৈতিক মানদন্ডে ফেলে জাতীয় আয়ে তাদের অবদান তুলে ধরতে হবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মোঃ নজরুল ইসলাম চৌধুরীজানান, ৮ম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২০-২০২৫) জেন্ডার সম্পৃক্ত রূপকল্প হলো দেশে নারী ও পুরুষের সমতাকরণ। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনে ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মস্থলে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন চলছে।

 

 

Check Also

দুর্নীতিবাজ, খুনি, স্বার্থান্বেষী মহলকে আর ক্ষমতায় দেখতে চাই না: চরমোনাই পীর

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, ইসলামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।