আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : প্রখর রৌদ্র, গ্রীষ্মের তাপদাহ ও বৃষ্টিপাতের দেখা না মেলায় সাতক্ষীরা জেলার বেশির ভাগ নদ-নদী, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর শুঁকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। অন্যদিকে নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, শিল্প কারখানার দূষণ, পলি ভরাট, বৈশ্বিক উষ্ণতা, ফাঁরাক্কাবাঁধ, অকেজো স্লুইস গেট ও খননের নামে চরম দুর্নীর্তির কারণে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। ফলে নদী সংযুক্ত জেলার ৪২৯টি খাল সংকটে পড়েছে। এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টি স্লুুইস গেটের বেশির ভাগ অকেজো। ২৭টি নদীর ১৩ টি পলিপড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী থেকে প্রবাহিত চার শতাধিক খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। পানিউন্নয়ন বোর্ড বলছে, জেলার ১৪টি নদী কোন রকমে টিকে আছে। এসব নদীর শাখা প্রশাখায় প্রবাহিত রয়েছে ৪২৯ টি খালে জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় নদী ও খালের বুকে জেগে উঠা চরে মানুষ বসতি শুরু করেছে। পাউবো-১ এর একটি তথ্যে দেখা যায় ১২৩টি স্লুুইস গেটেরে মধ্যে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে নির্মিত ৩৫টি, ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালে নির্মিত ৫টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ৩০টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৪৮টি এবং ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সালে নির্মিত ৫টি। যার বেশির ভাগ স্লুুইস গেটের মেয়াদই শেষ। সূত্রটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১২৩টি স্লুইস গেট রয়েছে। যার ৮০টি কার্যক্ষম আছে বাকি ৩৪ টি সম্পূর্ণ অকেজো। এছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ৯৩ টি স্লুইস গেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো। ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের জনজীবন।
পাউবোর যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ বাস্তবায়ন করে পাউবো। ২৮৬ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৭ সালে। এরপর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০২০ সালে। শেষ হবে ২০২৪ সালে। প্রকল্পের আওতায় ছয়টি এলাকা পুনঃখনন ও ড্রেজিং করা হচ্ছে। কপোতাক্ষ নদ পুনঃখননের পর দুই পাড়ের মধ্যে দূরত্ব হবে ৫৫ থেকে ৭০ মিটার পর্যন্ত। কপোতাক্ষ নদ ও এর শাখা নদী মিলিয়ে মোট ২৮১ দশমিক ৭০ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে। আর ড্রেজিং করা হবে ২৭ দশমিক ৩০ কিলোমিটার।
অভিযোগ উঠে সেই প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকায় লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে দিয়ে চেঁচে-ছিলে দায়সারা গোচের খনন করা হয়েছে। কপোতাক্ষ নদ খননের নকশা অনুযায়ী তলদেশ’র প্রস্ত হওয়ার কথা ছিল স্থান বিশেষ ১০৩ ফুট থেকে ১৩০ ফুট। মাথায় প্রস্থ’ হওয়ার কথা ছিল স্থান বিশেষ ১৪৮ ফুট থেকে ২০৩ ফুট এবং গভীরতা হবে স্থান বিশেষ ১০ ফুট থেকে ১৪ ফুট। কিন্তু খনন করা হয়েছে, তলদেশ প্রস্থ’ মাত্র ৩৩ ফুট, মাথায় প্রস্থ’’ মাত্র ৪৯ ফুট ও গভীরতা সাড়ে ৬ ফুট। খননকৃত মাটি ১৭০ ফুট দূরে ফেলার কথা থাকলেও মাটি ফেলে হয়েছে নদীর মাঝ খানে। অন্যদিকে জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে কলারোয়ার মুরারীকাটি থেকে সদরের সুপারীঘাটার দিকে ২৫ কিলোমিটার নদী খননের জন্য যে ব্যয় করা হয় তা কোন কাজে আসেনি। এছাড়া ২৫ কোটি টাকার খনন করা হয়েছে সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী । কিন্তু খননের পূর্বের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। খনন কাজের পূর্বে নদীটি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। কিন্তু খননের পর নদীটি পরিণত হয়েছে নালায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছে তাই ভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। এছাড়া ও যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই। তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান জানান, কপোতাক্ষ খননের প্রথম ফেইজের ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার এবং দ্বিতীয় ফেইজের ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা সরকার বরাদ্দ দিলেও ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টিআরএম এলাকার চাষিরা প্রথম দুই বছরের ক্ষতিপূরণ পেলেও পরবর্তী সময়ে আর পাননি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড- ১ ও ২ সূত্র জানান, নদী খনন ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ১১শ ৩৬ কোটি টাকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কাগজপত্র (ডিপিবি) পাঠানো হয়েছে। এছাড়া নদীর তীর সংস্কারের জন্য ১৬শ ৪৫ কোটি টাকা এবং জাইকার কাছে ৯০ কোটি টাকা চয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কাগজপত্র (ডিপিবি) পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু হবে।
সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এড. এুস্তফা লুৎফুল্লাহ জানান, সঠিক ভাবে প্রকল্পটির কাজ বাস্তবায়ন হলে দূর্ভগ কমবে এলাকা বাসির। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির জানান, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে জেলার নদী ও খালগুলো মারা যাচ্ছে। মৃত্য নদী ও খালে পানির প্রবাহ ধরে রাখতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জেলার নদী ও খালসমূহে অনেকটা গতি ফিরে আসবে।
জেলায় নদী নিয়ে কাজ করে সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, নদীরক্ষায় আমাদের সুপারিশ হচ্ছে, পানি প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টিকারী সব অবৈধ বাঁধ অপসারণ, সব চর দখলমুক্ত করা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং পরিবেশ বিধিমালা ১৯৯৭ বিবেচনায় নিয়ে নদীর দূষণ ও দখলমুক্ত করা, ১৯৯৫ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নদী-খাল ইজারা বন্ধ করা, পর্যায়ক্রমে নদীর সব ধরনের বাধা অপসারণ, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নদের সঠিক সীমানা নির্ধারণ করা এবং নদীর সঠিক সীমানা নির্ধারণ করে সীমানা সুরক্ষা ইত্যাদি।