মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের এমপিও বাতিল

ক্রাইমবাতা রিপোট:   সাতক্ষীরার সদর উপজেলার বৈকারি ইউনিয়নের মৃগিডাঙ্গার বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের এমপিও বাতিল করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি কলেজ শাখার সহকারি পরিচালক গত ৭ নভেম্বর ২০২৩ তদন্ত রিপোর্ট প্রাপ্তির পর এই আদেশ দেন। আলোচিত অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের বিরুদ্ধে অনার্স ও মাষ্টার্স পাশের সার্টিফিকেট জালজালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি করার অভিযোগ ছিল বরাবরই। এদিকে এই আদেশ প্রাপ্তির পরও কলেজ কমিটির সভাপতির যোগসাজসে এখনও তিনি উক্ত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যাওয়া আসা করায় কলেজে চাকরিরত শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা তাকে দ্রুত অব্যাহতি দানের জন্য সভাপতি বরাবর অনাস্থাপত্র জমা দিলেও তা গত ১০দিনেও কার্যকর হয়নি। এঘটনায় ক্ষোভ বাড়ছে উক্ত কলেজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পূর্বের নাম দাঁতভাঙ্গা মহাবিদ্যালয় যার বর্তমান নাম বীরমুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আদর্শ কলেজের এমএলএসএস আহম্মদ আলী গত ১৮ অক্টোবর ২০২৩ সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক বরাবর উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম অনার্স ও মাষ্টার্স এর ভূয়া সনদে চাকরি করা, অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সিনিয়রদের উপেক্ষা করে কলেজের জুনিয়র শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের এমপিওভুক্তিকরণ, কলেজের বিভিন্ন প্রকার গাছ অবৈধভাবে টেন্ডার ছাড়াই বিক্রি, সরকারের দেওয়া টিন পর্যন্ত অন্যের নিকট বিক্রয় অতপর পরবর্তীতে জানাজানি হলে ফেরত নেওয়া এমনকি কলেজ ক্যাম্পাসের মাটি পর্যন্ত বিক্রয় করে খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কলেজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। জেলা প্রশাসক অভিযোগটি পেয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর প্রেরণ করেন। অভিযোগটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে গত ৩মার্চ ২০২৪ সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার দাস তদন্ত কার্য শুরু করেন। তিনি এ নির্দেশনা প্রাপ্তি সাপেক্ষে গত ১৪মার্চ দুপুরে সরেজমিনে উক্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আর্দশ কলেজে যান। সেখানে তিনি কলেজ অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম, অভিযোগকারি আহমদ আলী, কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, কর্মকর্তা কর্মচারি, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, প্রাক্তন ও বর্তমান সদস্য এবং সুধিজনদের সাথে কথা বলেন ও লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেন। এরপর ৩১ মার্চ ২০১৪সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার দাস সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমদ বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ৯এপ্রিল-২৪ তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ভূয়া সনদধারি অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম প্রভাষক পদে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রাপ্তির সময়ে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এর ঢাকা উত্তরা ক্যাম্পাস হতে ২০০৬ সালে বিএ (সম্মান) ইংরেজি এবং ২০০৭ সালে একই ক্যাম্পাস হতে এমএ ইংরেজি পাশ করেন মর্মে শিক্ষাগত সনদ দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তার নিকট। একই বক্তব্যে ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত উক্ত ক্যাম্পাসের অনুমতি ছিল মর্মে স্বীকার করেন। ফলে ২০০৭সালে এমএ পাশের সনদপত্রটি অবৈধ বলে প্রতীয়মান হয়। আবার অধ্যক্ষ নিয়োগের সময় সরকারি বিএল কলেজ খুলনা হতে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে ২০০৬ সনে বিএ (সম্মান) ইংরেজি পাশের সনদ ও মার্কসীট দাখিল করেন। কিন্তু একই সনে দুইটা বিশ^বিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে ২টা পৃথক সনদ পাওয়ার সুযোগ নেই মর্মে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হযেছে। এদিকে প্রভাষক নিয়োগের সময় এনটিআরসিএ শিক্ষক নিবন্ধন পরিক্ষা ২০০৭ এর প্রত্যয়ন পত্রের রোল নং ৪২০২০০০৫ দিয়ে সার্চ করলে অনলাইনে কোন নাম না আসায় সেটিও জালজালিয়াতি বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়। তবে অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের মতো একই বিশ^বিদ্যালয়ের একই সময়ের সার্টিফিকেট দিয়ে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছেন এমন হাফ ডজন শিক্ষকের উদহারণ দিয়ে নিজের সার্টিফিকেট বৈধ বলে দাবী করেন এই শিক্ষক। এদিকে ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে জেষ্ঠ্যতা লংঘনপূর্বক নিজেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আবার একইভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হতে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ লাভের সময় শিক্ষক রমজান আলী, লিয়াকত আলীকে উপেক্ষা করে শিক্ষক ওবায়দুল্যাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দেখিয়ে কথিত নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে নিজেই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এসময় একাধিক মিটিং এবং উপস্থিত শিক্ষকদের স্বাক্ষর জাল করার কথা জানানো হয়েছে রিপোর্টে।

প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, অভিযোগকারি আহমদ আলী ২০০৫ সালের ১১মার্চ তৎকালিন ‘দাঁতভাঙ্গা মহাবিদ্যালয়’ বর্তমানে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আদর্শ কলেজ এ এমএলএসএস পদে নিয়োগ পেয়ে ১৪ মার্চ ২০০৫ তারিখে উক্ত কলেজে যোগদানপূর্বক দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত বেনবেইজে তার নামও ছিল এবং ২০২২ সালের ৬ জুলাই কলেজটি এমপিও ভূক্ত হওয়ায় অধ্যক্ষের নির্দেশে ২৮ জুলাই ২২ সালে সরকারি বেতন ভাতা প্রাপ্তির জন্য রুপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন যার নং-১৮৬৯৫। এরপর ওই বছরের ২৩ নভেম্বর অধ্যক্ষ মহা-পরিচালক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর আহমদ আলীর এমপিও ভূক্তির জন্য আবেদন প্রেরণ করেন। কিন্ত তার বেতন ভাতা তো আসেইনি এমনকি ওই একই পদে অন্য জনের জন্য বেতন ভাতা প্রাপ্তির চেষ্টা করেন অভিযুক্ত এই অধ্যক্ষ। চাকুরিতে বেতন ভাতা প্রাপ্তির জন্য নিজের বসত বাড়ির জমি বিক্রয় করে আহমদ আলী ১লাখ ১০হাজার টাকা দিয়েও বেতন ভাতা না আসায় বর্তমানে পারিবারিক কবরস্থানে বসবাস করেন আহমদ আলী আর জীবন জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন রকম কাজ করছেন তিনি।

শুধু তাই নয় উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়েছে, আলোচিত এই অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম নানাভাবে ছলচাতুরি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে জেষ্ঠ্যতা লংঘন পূর্বক ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন উক্ত কলেজের যুক্তিবিদ্যা বিভাগের শাহাজান কবিরকে। তার স্থানে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন জিললুর রহমানকে। বর্তমানে এই নিয়োগের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিট ফাইল করেছেন শাহাজান কবির। একইভাবে এমএলএসএস মো: ইলিয়াসকে জেষ্ঠ্যতা লংঘন করে আনিসুর রহমানকে এমপিও ভুক্তির সুপারিশ করেছেন এই অধ্যক্ষ। পাশাপাশি হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের তাপস কুমার মন্ডলকে উপেক্ষা করে আব্দুর রহিম, অফিস সহকারি আব্দুল ওয়াদুদের জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে তারিকুল ইসলাম ও সোহাগকে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশ করেন অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই অধ্যক্ষ কথিত রাজনৈতিক এক ব্যক্তির উপর ভর করে তিনি যোগদান থেকে এ পর্যন্ত এমএলএসএস পদে ১২-১৪জন ও প্রভাষক পদে ৭জনকে নিয়োগ দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তদন্তে তদন্তকারি কর্মকর্তা নিজেই হতবাক হয়েছেন অভিযোগ অনুযায়ী সত্যতা পাওয়ায় তিনি জানিয়েছেন, কলেজের জমি অধ্যক্ষ কর্তৃক দখলে নেওয়া, বেষ্টনি ও আশ্রয়কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মানের জন্য আম বাগানের ১৮৫টি গাছ বিক্রয়, কলেজ ক্যাম্পাসের মাটি পর্যন্ত ট্রলি চুক্তিতে ১হাজার ট্রলি মাটিও বিক্রি করা এবং কলেজ ক্যাম্পাসের মসজিদের নামে সরকারি টিন উত্তোলনপূর্বক তা পাবলিকের কাছে বিক্রয় করে এসব অর্থ আত্মসাত করেছেন এই অধ্যক্ষ। এদিকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার দাস কর্তৃক সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানের পর বর্তমানে উক্ত কলেজ ও ওই এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, বাংলাদেশে এই প্রথম সাতক্ষীরা জেলায় আইএ পাশ অধ্যক্ষ পাওয়া গেল।
অপরদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি কলেজ শাখার গত ২ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মৃগিডাঙ্গা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের এমপিওভুক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিচালক মাওশি খুলনা, মহাপরিচালক মাউশি বরাবর পেশ করেন। উক্ত আবেদনের বিষয়ে এমপিও কমিটির সভায় উপস্থাপন পূর্বক আলোচনা শেষে দ্যা ইউনির্ভাসিটি অব কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়র সাময়ীক অনুমতিপত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় উক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের আইনগত কোন ভিত্তি না থাকায় অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই মর্মে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এমর্মে একটি পত্রও গত ৭ নভেম্বর ২০২৩ উক্ত বিভাগের সহকারি পরিচালক (ক-৩) তপন কুমার সাহা স্বাক্ষরিত কলেজে প্রেরণ করা হয়েছে। যা কলেজ কমিটির সভাপতি জানান।
এসব বিষয়ে গতকাল রাতে অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের ব্যক্তিগত সেল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিক এসব বিষয়ে কলেজ কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম রাতে তার সেলফোনেএ প্রতিবেদককে জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি কলেজ শাখার যে প্রতিবেদনে অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমকে এমপিওভুক্তি স্থগীত করেছে তার বিরুদ্ধে তিনি মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেছেন। ফলে এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তার কিছুই করার নেই বলে মতামত দেন। তবে সামুগ্রিক বিষয় নিয়ে অতিদ্রুত ম্যানেজিং কমিটির মিটিং আহবান করা হবে। সেখানে আলোচনা সাপেক্ষে অন্যান্য বিষয়ে ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

Please follow and like us:

Check Also

নিঃস্ব সাতক্ষীরার হাজার হাজার মানুষ: ভূক্তভোগীরা জানতে চান, এভাবে চলবে আর কতদিন?

উপকূলের ভয়ংক্তার মে আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: উপকূলের ভয়ংক্তার মে। মে মাস মানেই উপকূল বাসীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।