উপকূলের ভয়ংক্তার মে
আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: উপকূলের ভয়ংক্তার মে। মে মাস মানেই উপকূল বাসীর আতঙ্কের নাম। প্রতি বছর মে মাসের শেষ দশক আসলেই গা শিহরে উঠে এখানকার মানুষের। ২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফনি এবং ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান আঘাত হানে উপকূলে। লন্ডভন্ড হয়ে যায় সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জনপদ। নিমিশেই তছনছ হয়ে যায় গোটা উপকূল অঞ্চল। বিশেষ করে আইলা ও আম্পানের সেই ক্ষত আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। উপকূলীয় এসব জনপদে ঘূণিঝড়ের ক্ষত স্পষ্ট। সোমবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবের চার বছর পূর্তি। ২০২০ সালের ২০ মে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে ঘুণিঝড় আম্পান। প্রলয়ঙ্করি এ ঝড়ের শিকার অনেক এলাকার মানুষ আজো সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলায় শুধু সাতক্ষীরায় নিহত হয় শিশুসহ ৭৩ জন নারী-পুরুষ। এর মধ্যে ৫৩ জন মারা যায় শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে। বাকি ২০ জন পার্শ্ববর্তী পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেই জনপদে এখনো চলছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও সুপেয় পানির তীব্র হাহাকার। চিকিৎসা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সংকটে বিপর্যস্থ এখানকার লাখ লাখ মানুষ। কাজ না থাকায় বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সবকিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই স্বল্প আয়ের এসব মানুষের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। আয়ের সব পথ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভিটেমাটি হারিয়ে তাদেরকে বাস করতে হয় খোলা আকাশের নিচে। পরিবার নিয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। ভূক্তভোগীরা জানতে চান, এভাবে চলবে আর কতদিন?
শুনতে আশ্চর্য শোনালেও সত্যিটা হলো, স্বাধীনতার ৫২ বছরে উপকূল সুরক্ষায় নতুন একটি পোল্ডারও তৈরী করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে তৈরী বেড়িবাঁধ সংস্কার আর পুনঃনির্মাণেই কেটে গেছে ৫২টি বছর! অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম জানান, ষাটের দশকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তান সরকার। ষাট বছরে ভাঙতে ভাঙতে যার অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবণপানি প্রবশ করায় একসময়ের সবুজ শ্যামল জনপদ গাবুরায় কৃষি উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত আর নদীর ভাঙ্গন এ দ্বীপকে এতটাই ভঙ্গুর করে দিয়েছে যে, এখানে এখন আর বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজন হয় না। অমাবস্যার জোয়ারে পানির চাপ একটু বাড়লে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে বাড়িঘর হারিয়ে অনেকে এখনো বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি তুলে বসবাস করছেন। অনেক এলাকার জমি ও চিংড়ির ঘের এখনো চাষের উপযোগী হয়নি। কৃষক বা চিংড়ির ঘেরের মালিকদের অনেকে এখন দিনমজুর। কেউ কেউ সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছেন।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দেশের বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সুপার সাইক্লোন সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্থ হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্থ হয়।