শ্যামনগর প্রতিনিধিঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় উপজেলায় নিরাপদ সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিভাগের বৃষ্টির পানি প্রকল্পে ক্ষণিকের তরে সমাধান মিলছে। লবণাক্ত পানির কোন অভাব না থাকলেও সুপেয় পানির তীব্র সংকট বিরাজ করছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে ক্লোরাইড ও আর্সেনিকের মাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় দৈনন্দিন জীবনে সুপেয় পানি যেন রীতিমত এক জীবন যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। নিরাপদ সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে উপকূলের অধিকাংশ বাড়ির বয়োবৃদ্ধ নারী ও শিশুরা। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও প্রবল দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গাছপালা, গবাদী পশু,ফসলি জমিতে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং জীববৈচিত্র্যে মিষ্টি পানির অভাবে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। মানুষদের প্রাকৃতিক উৎসের পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। গ্রীষ্ম মৌসুমে মানুষের দুর্ভোগের সীমাহীন কষ্টে পায়ে হেঁটে, ভ্যান ও নৌকায় করে সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে হয়। নিরাপদ পানি আনতে যেতে হয় কয়েক মাইল কে মাইল। লবণাক্ত মৎস্য ঘের থাকায় গ্রামের এলোমেলো, আঁকাবাঁকা মেঠো পথে সময় অপচয় ও ব্যয় বহুল হয়।
এ অঞ্চলে জলবায়ু সংকটের কারণে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। বার বার দুর্যোগের ফলে সকল সুপেয় পানির পুকুর জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যায় ফলে পানীয় জলের সংকট আরও বেড়েছে। শুধু ভূ-উপরিস্থিত নয়, বরং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরেও লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। নদী-খাল-বিল-পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে, যা শুষ্ক মৌসুমে আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এসব উৎসর পানি পান করা ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করা যায় না। এই লবণাক্ত পানি পান করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়েরিয়া, আমাশয়,নারীদের গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা, কিডনি রোগ ও চর্মরোগের মতো নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এ উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তাছাড়া হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সুপেয় পানির অভাব মেটাতে পারছে না।এ উপকূলে সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা প্রশংসার দাবী রেখেছে। শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে পানি সংরক্ষণের ট্যাংক ও অন্যান্য সরঞ্জাম দেয়া হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। ‘সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ নামে দুটি প্রকল্পের আওতায় এই কাজ হচ্ছে।প্রকল্পের মুখবন্ধ অনুযায়ী জানা যায় যে, পানির উৎসের যাবতীয় সকল স্থান তালিকা ৫০% প্রণয়ন করেন জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাকি ৫০% প্রণয়ন করেন উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে। জনপ্রতিনিধিরা যাচাই বাচাই করে তালিা প্রণয়ন করে থাকেন। সে তালিকা অনুযায়ী বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ৩ হাজার লিটার বিশিষ্ট ট্যাংক বিতরণ, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম ও পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) কাজ সম্পন্ন হয়। পিএসএফের আওতায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন পুকুরগুলোকে পুনঃখননের মাধ্যমে কমিউনিটিভিত্তিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করার বিশেষ গুরুত্ব পায়। মিনিপাইপ ওয়াটার সাপ্লাই স্কিমের মাধ্যমে মূলত পুকুরের পানি বিশুদ্ধ করে পানের উপযোগী করা হয়। তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। তবুও হাজার হাজার মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে। পরিবারভিত্তিক রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম কাজ চলমান থাকায় তারা আাশায় বুক বেঁধে আছে। গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কৈখালী ইউপি চেয়ারম্যানগণ জানান, “সরকারি ভাবে পানির ট্যাংক পেয়ে তাদের এলাকায় হাজার হাজর মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উপকৃত হচ্ছেন। শ্যামনগর উপকূলে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে কিছুটা হলেও সমাধান মিলছে জনস্বাস্থ্য বিভাগের বৃষ্টির পানি প্রকল্প। সুপেয় পানি সংকট ছিল তা থেকে অনেকটা মুক্তি পেয়েছে। এই পানি দিয়ে এখন রান্না ও খাওয়ার কাজ ভালভাবে চলছে।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সোহরাব হোসেন জানান- উপকূলীয় এলাকার পানির ট্যাংক সরবরাহ আরও বাড়ালে সুপেয় পানি সংকট লাঘব হবে।”
ডাঃ আনিছুর রহমান জানান- সুপেয় পানি নিশ্চিত হলে মানুষের রোগ বালাই কম হবে, কাজ করার শক্তি বাড়বে, ফলে দেশের উন্নয়ন আরও বেগবান হবে। বৃষ্টির পানি সবচেয়ে নিরাপদ পানি। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে পর্যাপ্ত পানির ট্যাংক দরকার। শুধু টিউবওয়েল স্থাপন নয় ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা দরকার।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে মানুষকে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর শ্যামনগর উপজেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপকূলীয় এই এলাকার ৪০/৬০ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এ তথ্য দেয়া হলেও বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ বলে দাবী স্থানীয়দের।সাতক্ষীরা- ৪ আসনের এমপি এস, এম, আতাউল হক দোলন বলেন, এখন গরমকালে শ্যামনগর উপকূলীয় নিরাপদ খাওয়ার পানির সমস্যা সমাধানে সরকারি ভাবে তিন হাজার পানির ড্রাম বিভিন্ন ইউনিয়ন গুলোতে দেয়া হচ্ছে। এর পরিধি বাড়াতে চেষ্টা করছি। শ্যামনগরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এই উপকূলের অনেক পরিবার খাবার পানির কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে। একদিকে তারা সুপেয় পানি পান করতে পারছে অবার অন্যদিকে তারা পানিবাহিত অসুস্থতার থেকে মুক্তি পেয়েছে। এলাকাবাসী আরো জানান- জনস্বাস্থ্যের থেকে পানির ট্যাংকি পেয়ে তারা যেন এক নতুন জীবন পেয়েছে। পরিবারের বাহিরে ও অনেক মানুষ এখান থেকে উপকৃত হচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য হলেও শ্যামনগরবাসীর সুপেয় পানির কষ্ট লাঘবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের অবদান অনস্বীকার্য। শ্যামনগর উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এ এলাকায় মানুষের খাওয়ার পানির সংকট মোকাবেলার পানির সমস্যা দূরীকরণে জনস্বাস্থ্য বিভাগ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে। তবে বৃষ্টির অভাব, বন্যায় এলাকায় লবণ পানি ঢুকে যাওয়া এবং পুকুর, জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছেন।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজবুল আলম জানান- সুপেয় নিরাপদ খাবার পানির তীব্র অভাব পূরনে সরকারি ভাবে অধিকতর প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। শ্যামনগরের উপকূলবাসী নিরাপদ সুপেয়/মিষ্টি পানি সংকট উত্তোরণে টেকসই সমাধান পেতে অধিক হারে সরকারি পানির ট্যাংক বরাদ্দ, নলকূপ স্থাপন, দীঘি/ পুকুর খনন, খাল খনন, আরডব্লিউএইচ ও পিএসএফ কাজ অধিক বরাদ্দ , পাইপ লাইনে পানি সরবরাহ, সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ ও ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ প্রকল্প দুটির কাজ অধিক হারে বরাদ্দ করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।