ঘূর্ণিঝড় রেমাল আতঙ্ক, চার বছর পেরিয়ে গেলেও আম্পানের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারিনি উপকূল বাসী

আবু সাইদ বিশ্বাস. সাতক্ষীরাঃ চার বছর পেরিয়ে গেলেও সুপার সাইক্লোন আম্পানের ক্ষত রয়ে গেছে সাতক্ষীরার উপকূলে। আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ। ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্পানের ভয়াল স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি তারা। সেদিন সাতক্ষীরা উপকূলে ১৫১ কিলোমিটার বেগে আঘাত হেনেছিল আম্পান। টানা ১৫ ঘণ্টা চলে ঝড়, সৃষ্টি হয় ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। আম্পানের তান্ডবে জেলায় মোট ৮৩ হাজার ৪৩১টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় ২২ হাজার ৫১৫টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬০ হাজার ৯১৬টি। জেলায় ৮১ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ৫৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আম্পানের চারবছর পরে এখন উপকূলবাসীর রাত কাটে বেড়িবাঁধ ভাঙনের আতঙ্কে। যোগাযোগব্যবস্থা এখনও বলা চলে বিচ্ছিন্ন। চিকিৎসা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সংকটে বিপর্যস্ত উপকূলের মানুষ। নদীতে জোয়ার দেখলেই বুক কাঁপে উপকূলীয় বাসিন্দাদের। কারণ, ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙে, কপাল ভাঙে সাগরপারের মানুষের।

জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ১২ হাজার ৬৯৮টি মাছের ঘেরে ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। কৃষিতে ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মধ্যে ৬৫ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার আম, ৬২ কোটি ১৬ লাখ টাকার সবজি, ১০ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকার পান ও ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার তিল। গরু, ছাগল হাঁস-মুরগি মিলে ৯৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি হয় আম্পানের আঘাতে।

সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শুভদ্রকাটি গ্রামের আতাউর রহমান জানান, তাদের এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা মোটেই ভাল নেই। সুপেয় পানির সংকট তীব্র্র। এলাকার বেড়িবাঁধগুলোর অবস্থাও নাজুক। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র্র নির্মাণ ও টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসিম কুমার চক্রবর্তী জানান, ঘূর্ণিঝড়ের চার বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। এখনও সেখানকার মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব রয়েছে।

শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম জানান, ষাটের দশকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তান সরকার। ষাট বছরে ভাঙতে ভাঙতে যার অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবণপানি প্রবেশ করায় একসময়ের সবুজ শ্যামল জনপদ গাবুরায় কৃষি উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত আর নদীর ভাঙ্গন এ দ্বীপকে এতটাই ভঙ্গুর করে দিয়েছে যে, এখানে এখন আর বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজন হয় না। অমাবস্যার জোয়ারে পানির চাপ একটু বাড়লে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরো বলেন, এখানকার ৪০ হাজার মানুষ চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গ থেকে রক্ষা করার জন্য মূলত এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব বাঁধের স্থায়িত্ব ধরা হয় ২০ বছর। কিন্তু ৫৩ বছর উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও যথাযথভাবে এগুলোর সংস্কার করা হয়নি। ফলে বিশাল বিস্তৃত এলাকা এখন অরক্ষিত।

২০১৭ সালের নভেম্বরে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশে ঝড় থেকে সুরক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪৮টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালেই আঘাত করেছিল ২০টি ঘূর্ণিঝড়। এসব ঝড় উপকূল দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। এর বেশির ভাগ ঢুকেছিল খুলনা, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, বরিশাল অঞ্চল দিয়ে। দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় বোরো ধান ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঝড়ে।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়ের আতংকে দিন কাটাচ্ছে। নতুন করে ঘূণিঝড় রেমাল আতঙ্ক তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বাংলাদেশের নদীবেষ্টিত উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে। বিশেষ করে, হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করে বাংলাদেশ কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে এ জেলা থেকে।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান বলেন, ‘উপকূলীয় বাঁধগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ষাট বছর আগের বাঁধ যে এখনো সার্ভিস দিচ্ছে সেটাই অনেক বেশি। এছাড়া যে সময় বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো, সে সময় শুধুমাত্র জোয়ার থেকে জনবসতিকে রক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের চাপ বাঁধগুলো আর নিতে পারছেনা।’

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আম্পানে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল এই অঞ্চলের বেড়িবাঁধগুলোর। প্রধানমন্ত্রী পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেগুলো সংস্কারের। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনীসহ জেলার সংশিষ্ট সংস্থা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাঁধগুলোকে প্রাথমিকভাবে সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় রেমাল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।