রইসির মৃত্যু: পাল্টে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ!

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ান ও অন্যরা হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় শোকে মূহ্যমান ইরান। কিন্তু এর পরে কি ঘটে, ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে এর কি প্রভাব পড়ে সেদিকে নিবিড় দৃষ্টি রেখেছে বিশ্ব। পশ্চিম এশিয়াজুড়ে যখন উদ্বেগ বিরাজ করছে, ঠিক তেমন এক অত্যন্ত সঙ্কটময় সময়ে ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে এই দুর্ঘটনা ঘটলো। গত সাত মাস ধরে গাজায় নৃশংস যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। হামাসের রকেট হামলার জবাবে তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। তেল আবিবের বিরুদ্ধে লেবাননে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাগোষ্ঠীকে লেলিয়ে দেয়ার অভিযোগ বার বার আনা হয়েছে তেহরানের বিরুদ্ধে। ইসরাইল এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বহুদিন ধরেই। কিন্তু সেই উত্তেজনা ছিল চাপা, প্রকাশ্যে নয়। তা গত মাসে প্রকাশ্যে আসে। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কন্স্যুলেটে ইসরাইল হামলা চালিয়ে রেভ্যুলুশনারি গার্ডের দু’জন কমান্ডার সহ কমপক্ষে সাতজন সদস্যকে হত্যা করে।

ওই কন্স্যুলেট ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এর প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করে ইরান। তারই ফল হিসেবে গত মাসে ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ছোড়ে ইরান। তবে তাে ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম আকাশেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। ইরান জানিয়ে দেয়, তাদের কন্স্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ ছিল এটা। ইসরাইলও ইরানের এই হামলার জবাব দেয়। তারা ইরানের ইস্পাহান প্রদেশে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থায়। তবে তাতে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। উল্লেখ্য, ইস্পাহানে ইরানের বহুল আলোচিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা অবস্থিত।

 

এসব ঘটনার মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে নানা রকম জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় এটাকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ইরান সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছেন সবাই। যদি এক্ষেত্রে কোনোরকম দোষারোপের দিকে যায় ইরান বা যদি কোনো রকম নাশকতার প্রমাণ থাকে তাদের হাতে তাহলে স্পর্শকাতর ওই অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের সমীকরণ একই রকম থাকতে পারে। সরকার পরিচালনায় হাত লাগাবেন সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। সরকার এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনো রকম বিঘ্ন ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। প্রেসিডেন্ট রইসির মৃত্যুর খবরে তারা এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে এর আগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়েছে। তেহরান পারমাণবিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে গত কয়েক বছরকে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে সঙ্কটজনক পরিবর্তনের সময় হিসেবে দেখা হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার করা ঐতিহাকিক জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব একশন চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সঙ্গে সঙ্গে তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান তার চুক্তির সীমা লঙ্ঘনে উদ্বুদ্ধ হয়।

অবশেষে ২০২১ সালে ৬৩ বছর বয়সী রইসি ক্ষমতায় আসেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কঠোরভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার ফলে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হননি তিনি। পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর দস্তি থাকলেও এই উত্তেজনা কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে গাজায় যে পরিমাণ বেসামরিক মানুষ মারা যাচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র বেঁকে বসে। ফলে ইসরাইল যদি গাজার রাফায় আগ্রাসন চালায়, তাহলে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর কড়া জবাব দেয় ইসরাইল। তারা জানিয়ে দেয়, কেউ পাশে না থাকলেও ইসরাইল একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, আঞ্চলিক হামলাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা এড়ানোর জন্য ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় লিপ্ত ছিলেন বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। কিন্তু এখন রইসির মৃত্যুতে ওই অঞ্চল আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠার আশঙ্কা আছে। অস্থিতিশীল এই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করার দিকে দৃষ্টি দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

ওদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট রইসির বিয়োগান্তক মৃত্যুতে তিনি গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত ও বেদনাহত। ভারত-ইরান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে রইসির অবদানকে সবসময় স্মরণ করা হবে বলে মন্তব্য করেন মোদি। তিনি বলেন, তার পরিবার এবং ইরানের জনগণের প্রতি আমার হৃদয়ঘন সহানুভূতি। এই বেদনার সময়ে ইরানের পাশে আছে ভারত। মাত্র কয়েকদিন আগে ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনার জন্য ইরানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে নয়া দিল্লি। এর মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যকে বিস্তৃত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা ২০২৩ সালে প্রথম প্রস্তাব করে ভারত। কিন্তু বন্দরটির উন্নয়ন কার্যক্রমে ধীর গতি চলে আসে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সন্দেহের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞায়। ফলে চুক্তি হওয়ায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, ইরানের সঙ্গে যেকেউ ব্যবসা বিষয়ক চুক্তি করলে তাদের নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। এর জবাব দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ওই বন্দর পুরে অঞ্চলকে সুবিধা দেবে। এটা নিয়ে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো উচিত নয়। তিনি বলেন, যদি আপনারা চাবাহার বন্দরের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দেখেন, তাহলে দেখবেন- এই বন্দরের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলেছে, চাবাহারের একটি বিশাল প্রাসঙ্গিকতা আছে। আমরা এর সঙ্গে কাজ করবো।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ইসরাইলের সঙ্গেও ভারতের শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। হামাসের আক্রমণের পর নয়া দিল্লি সমর্থন দিয়েছে ইসরাইলকে। এ জন্য নয়া দিল্লির প্রশংসা করেছে তেল আবিব। এমন প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট রইসির মৃত্যুতে সমীকরণ কোনদিকে মোড় নেয়- তাই দেখার বিষয়। mzamin

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।