হুহু করে লোকালয় ঢুকছে সাগরের পানি
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে তীব্র জোয়ারের ধাক্কায় বিভিন্ন জায়গায় উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে পড়েছে। হুহু করে লোকালয় ঢুকে পড়ছে সাগরের পানি। প্লবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। দুপুর থেকেই দমকা ঝড়ো হাওয়ার শুরু হওয়ায় জলোচ্ছ্বাসে প্লবিত হয়েছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। বাদাবনে ভূমি ভেসে যাচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে। ডুবে গেছে হিরণ পয়েন্টের বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মৃতি ফলক। সেইসঙ্গে বইছে ঝড়ো হাওয়া। উত্তাল হয়ে উঠেছে উপকূলের খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদ। নদীতে উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বাড়ছে পানি। ঝড়ো দমকা হাওয়ার সঙ্গে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ মানুষ মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। সূত্র বলছে, নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে গত ৫০ বছরে উপকূলের উপরদিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রাণহানি ঘটেছে। ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে এসব এলাকায় ১৩টির বেশি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন, সম্পদ, আশ্রস্থল, গবাদিপশু এবং উপকূলীয় অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় ৮ হাজার ৯০০ বর্গকিলোমিটার বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
গবেষণা সূত্র জানায়, গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটেছে ১৯৭০ সালের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৩ লাখ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার গতি আসা ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ হাজার ২৭৯ প্রাণহানি হয়। একই বছর ডিসেম্বরে ২১৭ কিলোমিটার গতিতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ৮৭৩ প্রাণহানি হয়। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৮৫০ জনের প্রাণহানি হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার। এর আঘাতে ১১ হাজার ৬৯ প্রাণহানি হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ২২৫ কিলোমিটার গতিতে আসা ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬ থেকে ৭.৬ মিটার। এই দুর্যোগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ প্রাণহানি হয়। ১৯৯৭ সালের মে মাসে ২৩২ কিলোমিটার বেগে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৭ সালের নভেম্বরের সিডরে ২ হাজার ৩৬৩ জনের প্রাণহানি হয়। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের মে মাসের আইলায় ১৯০ প্রাণহানি হয়। ২০২০ সালের ২০ মে ঘুর্ণিঝড় আম্পানে ২০ জনের প্রাণ হাণি হলেও ও বেড়িবাঁধসহ ফসলাদিও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণি, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ২০২১ সালে ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও সর্বশেষ ঘণিঝড় অশণি আঘাত হানে । প্রতিবছর এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ভাঙাচোরা অববাঠামো আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে করে উপকূলবাসী জীবন-জীবিকা এবং মূল্যবান অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুরের সালাউদ্দীন জানান, পাতাখালীতে প্রচন্ড ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেড়িবাঁধের ওপর। ইতোমধ্যে বাঁধের নিচের মাটি সরে গেছে। যে কোনো সময় ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লবিত হওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের কয়েকটি জায়গায় নদীর বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। কিন্তু বাঁধ ভেঙে গেলে কিছু করার থাকবে না।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের অগ্রভাগ সকাল থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে ঢুকেছে। বর্তমানে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করতে পারে। তিনি আরো বলেন, এ সময় উপকূলীয় নদীতে ৮-১২ ফিট উচ্চতার জ্বলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হতে পারে ভারী বৃষ্টি। ঝড়ের গতিবেগ থাকবে ঘন্টায় ৯০-১২০ কিলোমিটার। এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮৮৭টি আশ্রয় কেন্দ্র আশ্রয়ে আনা হচ্ছে। ১০ নম্বর বিপৎসংকেত জারির পর আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে উপকূল জুড়ে শুরু হয়েছে মাইকিং। ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে জানমালের নিরাপত্তায় স্থানীয় মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্র্রে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
জেলার আশ্রয় কেন্দ্র গুলো যথেষ্ঠ নিরাপদ না থাকায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ও দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরায় আশ্রয়কেন্দ্র্রে গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত কাউকে যেতে দেখা যায়নি। তবে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম বলেন, ইতোমধ্যে আশ্রয়ক কেন্দ্র ্র গুলোতে প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদের নেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন জানান, ৩৮০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ইতোমধ্যে বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট মেরামত করা হয়েছে। এছাড়া যদি বাঁধের ভাঙন দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক মেরামতের জন্য জিও ব্যাগ মজুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে চার ফুট পানি বেড়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজিবুল বলেন, উপজেলায় ১৬৩টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্য বহুতল ভবন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায়শুকনা খাবারসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী মজুত আছে। ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা দেখে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, আমি সবাইকে শেষবারের মতো আহ্বান জানাবো- কালক্ষেপণ না করে যে সকল এলাকা অ্যাফেক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে সবাই এক্ষুণি নিরাপদ আশ্রয়ে যান।