‘উপকূলের কান্না, শুনতে কি পান না’ স্লোগানে উত্তাল সাতক্ষীরার উপকূল

‘আর চাই না ভাসতে, এবার চাই বাঁচতে’,

‘মিথ্যা আশ্বাস আর নয়, এবার টেকসই বাঁধ চাই’,

আবু সাইদ বিশ^াস, সাতক্ষীরাঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে গত ৫০ বছরে উপকূলের উপরদিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রাণহানি ঘটেছে। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় ৮ হাজার ৯০০ বর্গকিলোমিটার বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আকাশে মেঘ ডাকলেই মানুষরা আঁতকে ওঠেন। পানি একটু বাড়লেই ঘুম বন্ধ হয়ে যায় তাদের। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভুক্তভোগীরা বলছে জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ সংস্কারে শুধু সরকারী অর্থের অপচয় হয়েছে। গত শতকে অর্থাৎ ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ৪০টি প্রাকৃৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে এসব অঞ্চলে। ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে এসব এলাকায় ১৩টির বেশি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন, সম্পদ, আশ্রস্থল, গবাদিপশু এবং উপকূলীয় অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

‘আর চাই না ভাসতে, এবার চাই বাঁচতে’,‘মিথ্যা আশ্বাস আর নয়, এবার টেকসই বাঁধ চাই’, ‘উপকূলের কান্না, শুনতে কি পান না’-এমনই নানা স্লোগান স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল। এলাকার জানমালের নিরাপত্তার জন্য টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলের শত শত মানুষ। তরুণী নিশাত মেহজাবিন স্বর্ণা, বলেন, আমরা শিশু, আমাদের কি অপরাধ, আমরা আর চাইনা ভাসতে, চাই আমরা বাঁচতে! বুধবার (২৯ মে) স্থানীয় শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী পয়েন্টে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ওপর এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। উপকূলবাসী আয়োজিত এই মানববন্ধনে স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মাজেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন, আবু তাহের, মোক্তার হোসেন, তরিকুল, স. ম ওসমান গনি সোহাগ, মাসুম বিল্লাহ, নিসাত, রায়হান প্রমুখ।

আবু তাহের বলেন, শুধু ঘূর্ণিঝড় রিমাল নয়, প্রতিবারই এমন পরিস্থিতিতে কর্তা ব্যক্তিরা শুধু আশ্বাসের বুলি আওড়ান। শোনান নানা মেগা প্রকল্পের গল্প। কিন্তু গাবুরা ব্যতীত অন্য কোথাও এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিনি আরো বলেন, উপকূলের মানুষকে বাঁচাতে টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে স্থানীয়দের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন। বারবার নয়, একবারই মরতে চাই। মোক্তার হোসেন বলেন, ষাটের দশকের বেড়িবাঁধ প্রায় অর্ধশত বছর ধরে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এ কারণে সামান্য ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে উপকূলের মানুষ। তারা ঝড়কে ভয় পায় না, ভয় পায় বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়াকে। উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে গত কয়েক বছরে হাজারো পরিবারকে বাস্তুচ্যূত হতে হয়েছে। মাওলানা আাব্দুল জলিল জানান, উপকূলের মানুষকে জিম্মি করে বাঁধ ভাঙার আশায় থাকেন এক শ্রেণীর অসাধু জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারেরা। বাঁধ মেরামতের নামে তাঁরা লাখ লাখ টাকা লোপাট করেন। তিনি উপকূলীয় এলাকার মানুষকে বাঁচাতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।

 

গবেষণা সূত্র জানায়, গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটেছে ১৯৭০ সালের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৩ লাখ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার গতি আসা ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ হাজার ২৭৯ প্রাণহানি হয়। একই বছর ডিসেম্বরে ২১৭ কিলোমিটার গতিতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ৮৭৩ প্রাণহানি হয়। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৮৫০ জনের প্রাণহানি হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার। এর আঘাতে ১১ হাজার ৬৯ প্রাণহানি হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ২২৫ কিলোমিটার গতিতে আসা ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬ থেকে ৭.৬ মিটার। এই দুর্যোগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ প্রাণহানি হয়। ১৯৯৭ সালের মে মাসে ২৩২ কিলোমিটার বেগে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৭ সালের নভেম্বরের সিডরে ২ হাজার ৩৬৩ জনের প্রাণহানি হয়। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের মে মাসের আইলায় ১৯০ প্রাণহানি হয়। ২০২০ সালের ২০ মে ঘুর্ণিঝড় আম্পানে ২০ জনের প্রাণ হাণি হলেও ও বেড়িবাঁধসহ ফসলাদিও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণি, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ২০২১ সালে ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও  সর্বশেষ ২৬ মে ২০২৪ ঘণিঝড় রেমাল আঘাত হানে । প্রতিবছর এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ভাঙাচোরা অববাঠামো আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে করে উপকূলবাসী জীবন-জীবিকা এবং মূল্যবান অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে।

 

জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব এড. আবুল কালাম আজাদ, জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরা উপকূল বিদ্ধস্ত করেছে। প্রায় ১০ঘন্টাব্যাপী তান্ডবে সাতক্ষীরার জেলার উপকূলের প্রায় দুইলক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, আংশিক ও সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়েছে ১৫০০ ঘর-বাড়ি, তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের ও কৃষিজমি। চরম ক্ষতির শিকার হয়েছে মৌসুম ফসল ও আমচাষীরা। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলার সকল মানুষ। প্রাণহানি হয়েছে ১জনের ও মারা গেছে সুন্দরবনের অসংখ্য হরিণসহ নিরীহ প্রাণী, অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে জীব বৈচিত্র্য ও সুন্দরবনের-যার অর্থনৈতিক ক্ষতি পরিমাপ করা যায় না।

 

শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায় রেমাল তান্ডবে শ্যামনগরের এক রাখ ৫৬ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া পাঁচশ ৪১টি বসতঘরসহ কয়েক হাজার গাছ-গাছালি উপড়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে লোকালয়ে ঢুকে পড়া তিনটি হরিণকে চিকিৎসা শেষে কলাগাছিয়া টহলফাঁড়িতে অবমুক্ত করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক একেএম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন চারটি স্টেশনসহ ১২টি টহলফাড়ির মধ্যে আটটির পল্টুন ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়া বন্যপ্রাণীর খাবারের উপযোগী পানির ব্যবস্থা করতে বনের মধ্যে খননকৃত ১৬টি মিষ্টি পানির পুকুর সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। তিনি আরও জানান, সাগর সংলগ্ন মান্দারবাড়িয়া ও হলদেবুনিয়া টহলফাঁড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার ইমারন হোসেন জানান  মঙ্গলবার পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে না ভাঙলেও সাড়ে তিন কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিবুল আলম জানান, সাত শতাধিক চিংড়িঘের পানিতে ভেসে গেছে বলেও তিনি জানান। স্থানীয়দের অভিযোগ, পাউবো যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করায় বেশির ভাগ বেড়িবাঁধের উচ্চতা কমে যাওয়ায় নদ-নদীতে বড় জোয়ারের চাপ সামলানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

 

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবির (২৮শে মে) মঙ্গলবার আশাশুনিতে ক্ষতিগ্রস্থ ভেড়িবাঁধ পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চাউল বিতরণ করেছেন। এসময় দ্রুত বেড়ি বাঁধ সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দেন তিনি।

আবু সাইদ বিশ^াস

Check Also

বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেবহাটায় মানববন্ধন

দেবহাটা প্রতিনিধি: স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসর এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের গ্রেফতার এবং বিএনপির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।