স্টাফ রিপোর্টার : সুন্দরবনের কটকা অঞ্চল থেকেই ৩৯টি হরিণ ও একটি শূকরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অসুস্থ ও আহত অবস্থায় ১৭টি হরিণও উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। বনবিভাগের তল্লাশি চলছে। মৃত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আরও অনেক বাড়ার আশঙ্কা কর হচ্ছে। ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বনের ভেতরে ৮০টি পুকুর লবণ পানিতে ভরে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন ঢাল হয়ে না দাঁড়ালে ক্ষতির মাত্রা আরও ব্যাপক হতো। তবে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়েছে অনেক। ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে অসংখ্য হরিণসহ বিভিন্ন বণ্যপ্রাণী। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরবনের কটকা এলাকা থেকে ৩৯টি হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া একটি মৃত বন্য শূকর এবং অসুস্থ ও আহত ১৭টি হরিণ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ।
আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হচ্ছে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী। তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারানোর প্রাণীর সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে বনবিভাগ। এছাড়া রিমেলে বনের অভ্যন্তরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরবনের ৮০টি মিঠা পানির পুকুর ৮ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে লবণ পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে বনকর্মীদের পাশাপাশি বাঘ, হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির সংকট তৈরি হয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তা-ব ও জ্বলোচ্ছাসে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে অনেক হরিণ মারা গেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৯টি মৃত হরিণ, একটি মৃত বন্য শূকর ও অসুস্থ অবস্থায় ১৭টি হরিণ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। মৃত বন্যপ্রাণীর সন্ধানে বন জুড়ে বনরক্ষীদের তল্লাশি চলছে। তল্লাশিতে আরও মৃত বন্যপ্রাণী উদ্ধারের আশঙ্কা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বনের গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বনবিভাগের বিভিন্ন অফিসসহ টহল বোট, টিনের চালা, জানালা-দরজা, সোলার প্যানেল ও অবকাঠামোর। কটকা অভয়াণ্যের অফিস ঘাটের জেটি ও পুকুর বঙ্গোপসাগরের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। দুবলা, কটকা, কচিখালি, বগি ও বিভিন্ন অফিসসহ ২৫টি টহল ফাঁড়ির রান্নাঘরসহ অবকাঠামোর টিনের চালা উড়ে গেছে।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আক্রমণে পর্যটক চলাচলের কাঠের পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে তছনছ হয়েছে অসংখ্য গাছপালা।
এদিকে রিমালের তা-বে বাগেরহাট জেলায় বিধ্বস্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি। এর মধ্যে আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ১০ হাজার বাড়িঘর। উপড়ে পড়েছে কয়েক হাজার গাছপালা। এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে জেলার প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে মৎস্য ঘেরের। জেলার ৪২ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার। এক হাজার ৫৮১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার তিন হাজার ৬০০ পুকুর ও ৯ হাজার ১১৫টি ঘের তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, রেমালের আঘাতে খুলনার ৯ উপজেলার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া ও রূপসা উপজেলার ৩৮ ইউনিয়নের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ওই ছয়টি উপজেলার ৩৫৫ দশমিক ৩০ হেক্টর জমির তিন হাজার ৬০০টি পুকুর এবং ১০ হাজার ২২৩ দশমিক ৭৫ হেক্টর জমির ৯ হাজার ১১৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির ১ হাজার ৩৫৬টি কাঁকড়া/কুচিয়া খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, এবারের ঝড়ে মোট ক্ষতি হয়েছে ২৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার মৎস্য সম্পদ। যার মধ্যে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৭৮ মেট্রিকটন মাছ, ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের দুই হাজার ৫৬৪ মেট্রিকটন চিংড়ি, ২০ কোটি ৫৭ হাজার টাকা মূল্যের ৬৩৬ মেট্রিকটন পোনা, ১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১০২ দশমিক ২০ মেট্রিকটন কাঁকড়া/কুচিয়া, ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৭০ মেট্রিকটন পিএল, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ২০টি নৌকা/ট্রলার/জলযান ও ১৬ কোটি ১১ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।